মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

প্রিয় বইয়েরা আমার

প্রিয় ১০ টি বইয়ের নাম বলা যেগুলো দ্বারা খুব প্রভাবিত আমার ব্যক্তি জীবন – বেশ কঠিন কাজই বটে। ফেবু-তে সবার তালিকা দেখে পড়তাম, ভালো লাগতো। অনেকের প্রিয় বইয়ের তালিকায় যখন আমারও ভালোলাগা বইগুলো থাকতো মনটা আরো বেশি উৎফুল্ল হতো। 

কিন্তু নিজের প্রিয় তালিকাটা দেয়ার তাগিদ অনুভব করি নি – কারণ সবাই কেন হঠাৎ তালিকা দেয়া শুরু করেছে তার কারণ জানতাম না, অবশ্য এখনো জানি না, কেননা যতটুকু জেনেছি সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নিকেউ একজন হুজুগ তুলেছে, সেই সাথে আমরা হুজুগে বাঙালিরা তাল মেলাচ্ছি। আর দুই নাম্বার কারণ ছিল দশটা পুস্তকের তালিকা দিলে আমার ভালো-লাগা, প্রভাবিত হওয়া বইয়ের খুব নগন্য একটা অংশেরই নামপ্রকাশ হতো সেটা। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না, প্রিয় ইমতিয়াজ ভাই উনার ভালোলাগা বইয়ের তালিকা দিয়েছেন, সাথে আমাকে ট্যাগ করেছেন, ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন আমার তালিকাটাও উন্মোচিত হোক। ছোট ভাই অনুপমও চাইলো দাদাও লিখুক তার প্রিয় সেই বইগুলোর কথা, যেগুলো তাকে  হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে, শিখিয়েছে। কাজেই কেউ পড়ুক আর না পড়ুক এই দুই জনের জন্য হলেও তালিকাটা করার একটা সুন্দর ইচ্ছা জাগ্রত হলো। মনের সব আবেগ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো আমার অনুভূতিগুলো কেন চাপা থাকবে আর! ধন্যবাদ ইমতিয়াজ ভাই, ধন্যবাদ অনুপম- নতুন করে আবার পুরনো সব ভাবনাগুলোকে  খুঁড়ে আনতে সাহায্য করার জন্য!

খুব ছোটবেলা থেকে একটা চমৎকার পড়ার অভ্যস তৈরি হয়েছিলো। বাংলা বই ছাড়া পাঠ্য বই খুব একটা ভালো লাগতো না। পরীক্ষা পাশের জন্য পড়তাম। কিন্তু বাংলা বইয়ের গল্প-কবিতাগুলো গ্রোগাসে গিলতাম; ছোট্ট একটা বই কতটুকুই বা ক্ষুধা মেটাতো। তবে হ্যাঁ, এত আনন্দের পড়াটা পরীক্ষার গৎবাঁধা পদ্ধতির মধ্যে পড়ে খাবি খেত।
বাল্যশিক্ষা পাঠের কথা এক-আধটু মনে আছে, কিন্তু ওই বইগুলো পাঠে অনেক আনন্দ পেয়েছিলাম এই ধরনের কোনো কিছু মনে পড়ছে না। গ্রামের স্কুলে পড়েছি, স্কুল আর পড়া ফাঁকি দিয়ে কীভাবে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘোরা যায় সে-সাধনায় বেশি রত ছিলাম।
প্রাইমারীর গণ্ডি পার হবার পর ‘আউট বই’ পড়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। বলতে দ্বিধা নেই আমার (পাঠ্যবই বহির্ভূত ) সেই কচি বয়সে  যেই বইগুলো মনে দাগ কেটেছিল সেগুলোর লেখকরা খুব বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। নীহাররঞ্জন-এর বই এর কথা মনে পড়ে- এই সব বই কোনোটাই আমার জন্য সহজলভ্য ছিলো না, বড়রা কেউ পড়তো, আমার হাতে পড়েছে – পড়ে ফেলেছি। এখনো মনে আছে কাসেম বিন আবুবকর নামে একজন লেখক ছিলেন - এখনো আছেন হয়তো- তার একটা বই খুব নাড়া দিয়েছিলো, বিয়োগান্তক সস্তা টাইপ প্রেমের উপন্যাস, নাম সম্ভবত ‘পাহাড়ী মেয়ে’। খুব মন খারাপ হয়েছিলো নায়ক বা নায়িকার মৃত্যুতে। রোমেনা আফাজ নামেও একজন লেখিকা ছিলেন, গ্রামে খুব চলত এই ধরনের বইগুলো। হাই স্কুল পাশ দিদিরা-বৌদিরা খুব পছন্দ করতো। তাদের কল্যাণে সেই সব পড়া। নিজে যখন কিছুটা ভালো-মন্দের বাছ-বিচার শিখেছে, ততদিনে শরৎচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্রের বইও হাতে এসে গিয়েছে।  বয়সন্ধি-কালের সেই ঘোর-লাগা সময় আমি শরৎচন্দ্রের হাত ধরেই পার হয়েছি। এত তুমুল আলোড়ন তার আগে কেউ তুলতে পারে নি আমার ভেতরদত্তা উপন্যাসটি আমি কমপক্ষে পাঁচ-ছয়বার পড়েছি। পড়ার একটা নেশা ছেপে গিয়েছিল তখন, হাতের কাছে পর্যাপ্ত বই পেতাম না, বারবার পড়তাম ভালো লাগা বইগুলো। নিজের টাকায় প্রথম বই কিনি হুমায়ূন আহমেদের বই। স্পষ্ট মনে আছে ‘বোতল ভূত’, ‘এবং হিমু’ দিয়ে হুমায়ূন পাঠ শুরু, আহা সেই সব ঘোর লাগা দিন!
কীভাবে কীভাবে যেন আনন্দবাজার আর দেশ এর পুজা সংখ্যা হাতে পেয়ে যেতাম। নীললোহিত এর অসম্ভব গুণমুগ্ধ হয়ে যায়। সমরেশ, শীর্ষেন্দুও পড়া হতে থাকে। নীললোহিত বা সুনীল এর প্রতি প্রতি সেই যে ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল, তা আজো ম্লান হয় নি। শীর্ষেন্দু-র মানব-জমিন, সমরেশ এর সাতকাহন সুনীলের পূর্ব-পশ্চিম, সেই সময় ঢাউস সব বই কী যে অবলীলায় শেষ করেছি এখন ভাবতেই অবাক লাগে। পরবর্তীতে কোনো এক সময় শীর্ষেন্দু-র পার্থিব পড়া শুরু করেছিলাম, শেষ করতে পারি নি।

উচ্চ-মাধ্যমিক এর পরে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কয়েকটা বছর বই পড়ার নেশাটা আরো তীব্রতর হলো। পড়া-কে এত ভালোবেসিছিলাম, শুধু বই কেনার জন্য দুইটা এক্সট্রা টিউশনি করতাম।  কৌশোর পেরুনো এই আমার গায়ে তারুণ্যের সোনামাখা রোদ গায়ে পড়েছিল তখন, কান্না-হাসির মন্দ-মধুর পৃথিবী খুব সহজেই দোলা দিত আমার নির্মল ও কোমল চিত্তে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ পড়ে শশীর জন্য এত খারাপ লাগা জন্মেছিল, আজো কান পাতলে আমি আমি সেই হৃদয় নিংড়ানো হাহাকারের ধ্বনি শুনতে পাই। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, আরণ্যক, যাযাবরের দৃষ্টিপাত, রবীন্দ্রনাথের গোরা, বুদ্ধদেবের তিথিডোর, হুমায়ূনের শঙ্খনীল কারাগার  তরুণ সেই মনে কী যে তুফান তুলেছিল, তা আজ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে ব্যর্থ। ওয়ালীউল্ল্যাহ-র কাঁদো নদী কাঁদো, চাঁদের অমবস্যা-র মত এই রকম চমৎকার উপন্যাস আছে বাংলা সাহিত্যে, তা জেনে কী ভালো লাগাই না লেগেছিলো। তবে অন্যরকম অনুভুতির জন্ম হয়েছিল কামু-র আউট সাইডার পড়ে। সেই এক অদ্ভূত অনুভূতি। চিনুয়া আচেবে-র থিংস ফল অ্যাপার্ট পড়ে অসম্ভব ভালো লেগেছিলো।
ছোট গল্পের কড়া যে স্বাদ সেটা পেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’ সে মন ছোঁয়া প্লেটোনিক গল্পের পুরানা পল্টন, মোনালিসা আজো জীবন্ত হয়ে আছে আমার স্মৃতির মণিকোঠায়। রবীন্দ্রনাথের কোনো ছোটগল্পের নাম উল্লেখ করবো না, কারণ প্রায় সবগুলোই গল্পই আমার সব-সময়ের প্রিয়।
দুইটা বই প্রায় কাছাকাছি সময়ে আমার ভাবনার জগতকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল। গোলাম হোসেন হাবীব স্যারের অনুবাদে পড়া ইয়েস্তেন গার্ডার-এর ‘সোফির জগত’ আর হুমায়ূন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’দর্শন-কে এত অসাধারণ করে উপস্থাপন করা যায়, সোফির জগত না পড়লে জানা হতো কি না সন্দেহ।
জীবনীগ্রন্থ কেন জানি না আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে। গোলাম মুরশিদ-এর ‘আশার ছলনে ভুলি মধুসূদন-এর প্রতি আমার ভালো লাগাকে তীব্রভাবে শানিত করেছে। মধুসুদন এর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রামায়ণ-পাঠের ভালোলাগাকে ছাপিয়ে গিয়েছেলসুনীলের ‘অর্ধেক জীবন’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এই জীবনের মধুর ভুলগুলি’ এপিজে আবুদুল কালামের ‘উইংস অব ফায়ার’ আমাকে ভাবনার অনেক খোরাক দিয়েছে। সম্প্রতি পড়া আরেকটা বই বেশ আয়েশ করে পড়ছি; স্পীক সোয়াহিলি, ড্যাম ইট! জেমস পেনহ্যালিগন নামক একজন লেখকের আফ্রিকা বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। এককথায় অসাধারণ। ওরহান পামুকের ‘ইস্তানবুল’কে আমার পড়া সেরা দশের বাহিরে রাখা অসম্ভব।

ভ্রমণ নিয়ে পড়া বইয়ের কথা বলতে গেলেই আসে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা। ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে ভালো’  বেশ লেগেছিল। মার্গারিট মেয়েটার কথা আজো মনে পড়ে। নির্মলেন্দু ‘এবং প্যারিস’ পড়েও নির্মল আনন্দ পেয়েছি। অন্নদাশংকরের ‘পথে প্রবাসে’ আমার পড়া সুলিখিত ভ্রমণ কাহিনী। তবে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভবগুরে শাস্ত্র’ পড়ে বুঝেছি সত্যিকারের পর্যটক হওয়াটা সাধনার ব্যপার! সাহসের তো বটেই!

ইতিহাস বই পড়তে হয়ছিল একাডেমিক কারণে। সেই সুবাদে বেশ কিছু বই মনে দাগ কেটে ফেলে। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাংলার ইতিহাস’ আহমদ শরীফের ‘বাঙালি ও বাংলাসাহিত্য’  দুটোই অসম্ভব পরিশ্রমী  কাজ। আর আহমদের শরীফের গদ্য বরাবরই সুস্বাদু। গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ আমার দারুণ ভালো লাগার বই। তবে আফ্রিকার ইতিহাস, রাজনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে লেখা রিচার্ড ডউডেনের আফ্রিকাঃ অল্টারড স্টেটস, অর্ডিনারী মিরাকলস’ পাঠের অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। 
 কবিতার কথা বলতে গেলে সবার আগে সবার শেষে একজনের নামই মনে পড়েঃ জীবনানন্দ দাশ। বাকি অনেক কবির কবিতায় আমি মুগ্ধ ছিলাম, এখনো আছি কিন্তু কিন্তু জীবনানন্দকে একদিকে বাকি সবাইকে আরেকদিকে রাখতে হয়।
 =========================================

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন