বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম তখন। কী একটা বিশেষ কাজে
আন্দরকিল্লা এসেছি। আকাশে গনগনে সূর্য। তপ্ত দুপুর। আন্দরকিল্লা মোড়টা
ধ’রে চেরাগির দিকে আসছিলাম বোধহয়। রোদের আঁচে আমার মুখ কিছুটা লালচে আকার
ধারণ করেছে। ঘামে ভেজা শার্ট আর গেঞ্জি শরীর জুড়ে লেপ্টে আছে। সেই রকম এক
দুপুরে অস্থির আমি আন্দরকিল্লার কোনো একটি দোকানে ঢুকে আর্ট-খাতা কিনি
একটা; সাথে জলরঙের একটা বক্স আর এক ডজন প্যাস্টেল রঙ। ইজেল-টিজেল কেনার
টাকা ছিল না, ঝামেলাও নিতে চাই নি। মোটা আর্ট-পেপারে বাঁধানো একটা খাতা।
ভাবলাম এটা হোক আমার ছবি আঁকার খাতা। ব্যাগের মধ্যে রাখা যাবে, আর যখনি মন
চাইবে আঁকিবুকিতে সাদা পাতাগুলোকে রঙিন করে দেব।
সেই খাতাটি আজো রয়ে গেছে কালের সাক্ষী হয়ে। খাতার পৃষ্টাগুলো মেলে ধরলে সেগুলো প্রজাপতি হয়ে আমার চারপাশে উড়তে থাকে। লাল-নীল-সাদা-কালো-সবুজ-হলুদের কত শত বিচিত্র রঙের প্রজাপতি। প্রজাপতিরা ওড়ে আর অদ্ভুত বিচিত্র সব কারণে আমার মনটা হারিয়ে যায় দূর অতীতে।
মনটা অল্পতেই কাতর ও আর্দ্র হয়ে যেতে পারত তখন! চোখ মুদলে ভেসে ওঠে কত-শত দৃশ্য! কত বিনিদ্র রজনী, বুক ভার করা মূহুর্তরা পুনরায় মস্তিষ্কের নিউরনে ঝড় তোলে। প্রত্যেকটা রেখা, রঙের আঁচড় আমার কত আনন্দ, কত স্বপ্ন, কত আকাঙ্ক্ষা আর আশঙ্কার অম্ল-মধুর গল্প ও তার চরিত্রদের লুকিয়ে রেখেছে। হয়তো কোনো বিশেষ কারণে মন ভালো নেই, সাদা কাগজের আকিঁবুঁকিতে সেই বেদনারা ছবি হয়ে মিলিয়ে যেত। বুকের ভেতর হয়তো চিনচিনে ব্যথা, চোখে জল, অব্যক্ত যন্ত্রণারা ভাষা পাচ্ছে না, তো খাতা আর বইয়ের সাদা পাতায় কালি-কলমের আঁচড়ে তারা পেয়ে যেত ভাষা, চিত্র-ভাষা; ব্যথারা, কষ্টরা, অশ্রুবিন্দুরা মিলিয়ে যেত ইত্যবসরে। সেই হিজিবিজি জীবন, হিজিবিজি যাপনের দিনলিপি পেন্সিলের ডগা থেকে কাগজের সাদা পৃষ্টায় কখনো সচেতনে কখনো অবচেতনে কালের সাক্ষী হয়ে গেল। বয়সটাই এমন যে, হৃদয়ে এই মেঘ এই রৌদ্র, এই ঝড় এই বৃষ্টি! এক পিঠে সুস্থিরতা তো আরেক পিঠে অস্থিরতা। সকালে নির্মোহ তো বিকেলে কামনায় জর্জর, আবার রাতে উদাসীন, নির্লিপ্ত। অর্থপূর্ণ জীবনে ডুবে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হ’য়ে হঠাৎ জীবনের নিদারুণ অর্থহীনতা কী চমৎকার অর্থপূর্ণভাবে ধরা দিত! একদিকে বৈষয়িকতার কুটিল মায়জালের ঘেরাটোপ, আরেক দিকে গৃহত্যাগের জন্য হাতবাড়িয়ে ডাকছে জোছনায় মাখামাখি অতিন্দ্রীয় রূপবতী রাত! মোহের নিগূঢ় আকর্ষণকে ভেঙে দেয়ার জন্য নির্মোহতাকে ডাকাডাকি! এই ভাবি, পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে, একটু কৌশলী হতে হবে, নিয়মানুবর্তী হওয়া দরকার; আবার সেই মনের ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঢুকে পড়ে অন্য চিন্তা, অন্য সাপ! মন বলে, প্রথম হওয়ার মত বিশ্রী ব্যাপার দ্বিতীয়টি নেই! প্যারাডক্স বা কূটাভাসের দূনিয়ায় তখন আস্তে আস্তে সেঁধে যাচ্ছিলাম। বেঁচে থাকাটাই একটা কূটাভাস তখন। হুমায়ুন আজাদের প্রবচনে প্রভাবিত হ’য়ে সফলদের শয়তানি জগত থেকে সুন্দর ও পবিত্র মনের প্রকৃত মানুষদের ব্যর্থ জগতের দিকে যাওয়ার লোভ হত খুব! ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছে মহান’–কে মনে হত আহা কি অমৃত বাণী! ভাবতাম, বা ভাবতে চাইতাম, না-পাওয়ার যন্ত্রণার মধ্যেও আছে কী এক অদ্ভূত সুখ! আর কবিতারা তো ছিল। অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতাকে কীভাবে অহঙ্কারের অলঙ্কার বানিয়ে গলায় পরা যায় কবিরা খুব ভালো জানতেন। সুনীল যেমন বলেছিলেন,
‘’প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই
সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন
আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে
আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে
আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।
কবিতা, গান বা যে কোনো সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র মনকে নাড়া দিত সহজেই, পলি-কাদা-জলে মাখামাখি মাটির মত বেশ নরম-সরম হৃদয় ছিল তখন। অবলীলায় সবকিছুর ছাপ পড়ে যেত সেখানে। কবিতা থাকতো মুখে মুখে। দুঃখের কবিতা, সুখের কবিতা, প্রেমের কবিতা, কামের কবিতা, রোমান্টিক কবিতা, দ্রোহের কবিতা প্রায় সব ধরনের কবিতা বা কবিতার বই থাকতো হাতের কাছে, মনের চাহিদা ও ইচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে কাব্য-চর্চা অর্থাৎ কাব্য-পাঠ চলতে থাকত। আর ছবি-আকাঁআকি তো ছিলই। আঁকার শুরুতে ভেবে নিতাম কী আঁকবো, কিন্তু পরে সেটা আর প্রায়ই মনে থাকত না। এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় হারিয়ে যেতাম। ধীরতা, স্থিরতা, একাগ্রতাজাতীয় ব্যপারগুলোতে তখনো নিমজ্জিত হয়ে যাই নি। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানার’ মধ্যে নিমঘ্ন ছিলাম অনেক বেশি। এখানকার বেশির ভাগ ছবি তারই সাক্ষ্য বহন করে। অস্থির, উম্মুল, উদভ্রান্ত প্রথম যৌবন। আহা, ফেলে আসা সেই সব দিন, সেই সময়! বড় বেশি ভালোবাসি তোমায়।
শনিবার,
মে ৩০, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ,
করোনাক্রান্তিকাল,
বনশ্রী, ঢাকা
সেই খাতাটি আজো রয়ে গেছে কালের সাক্ষী হয়ে। খাতার পৃষ্টাগুলো মেলে ধরলে সেগুলো প্রজাপতি হয়ে আমার চারপাশে উড়তে থাকে। লাল-নীল-সাদা-কালো-সবুজ-হলুদের কত শত বিচিত্র রঙের প্রজাপতি। প্রজাপতিরা ওড়ে আর অদ্ভুত বিচিত্র সব কারণে আমার মনটা হারিয়ে যায় দূর অতীতে।
মনটা অল্পতেই কাতর ও আর্দ্র হয়ে যেতে পারত তখন! চোখ মুদলে ভেসে ওঠে কত-শত দৃশ্য! কত বিনিদ্র রজনী, বুক ভার করা মূহুর্তরা পুনরায় মস্তিষ্কের নিউরনে ঝড় তোলে। প্রত্যেকটা রেখা, রঙের আঁচড় আমার কত আনন্দ, কত স্বপ্ন, কত আকাঙ্ক্ষা আর আশঙ্কার অম্ল-মধুর গল্প ও তার চরিত্রদের লুকিয়ে রেখেছে। হয়তো কোনো বিশেষ কারণে মন ভালো নেই, সাদা কাগজের আকিঁবুঁকিতে সেই বেদনারা ছবি হয়ে মিলিয়ে যেত। বুকের ভেতর হয়তো চিনচিনে ব্যথা, চোখে জল, অব্যক্ত যন্ত্রণারা ভাষা পাচ্ছে না, তো খাতা আর বইয়ের সাদা পাতায় কালি-কলমের আঁচড়ে তারা পেয়ে যেত ভাষা, চিত্র-ভাষা; ব্যথারা, কষ্টরা, অশ্রুবিন্দুরা মিলিয়ে যেত ইত্যবসরে। সেই হিজিবিজি জীবন, হিজিবিজি যাপনের দিনলিপি পেন্সিলের ডগা থেকে কাগজের সাদা পৃষ্টায় কখনো সচেতনে কখনো অবচেতনে কালের সাক্ষী হয়ে গেল। বয়সটাই এমন যে, হৃদয়ে এই মেঘ এই রৌদ্র, এই ঝড় এই বৃষ্টি! এক পিঠে সুস্থিরতা তো আরেক পিঠে অস্থিরতা। সকালে নির্মোহ তো বিকেলে কামনায় জর্জর, আবার রাতে উদাসীন, নির্লিপ্ত। অর্থপূর্ণ জীবনে ডুবে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হ’য়ে হঠাৎ জীবনের নিদারুণ অর্থহীনতা কী চমৎকার অর্থপূর্ণভাবে ধরা দিত! একদিকে বৈষয়িকতার কুটিল মায়জালের ঘেরাটোপ, আরেক দিকে গৃহত্যাগের জন্য হাতবাড়িয়ে ডাকছে জোছনায় মাখামাখি অতিন্দ্রীয় রূপবতী রাত! মোহের নিগূঢ় আকর্ষণকে ভেঙে দেয়ার জন্য নির্মোহতাকে ডাকাডাকি! এই ভাবি, পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে, একটু কৌশলী হতে হবে, নিয়মানুবর্তী হওয়া দরকার; আবার সেই মনের ভেতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঢুকে পড়ে অন্য চিন্তা, অন্য সাপ! মন বলে, প্রথম হওয়ার মত বিশ্রী ব্যাপার দ্বিতীয়টি নেই! প্যারাডক্স বা কূটাভাসের দূনিয়ায় তখন আস্তে আস্তে সেঁধে যাচ্ছিলাম। বেঁচে থাকাটাই একটা কূটাভাস তখন। হুমায়ুন আজাদের প্রবচনে প্রভাবিত হ’য়ে সফলদের শয়তানি জগত থেকে সুন্দর ও পবিত্র মনের প্রকৃত মানুষদের ব্যর্থ জগতের দিকে যাওয়ার লোভ হত খুব! ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছে মহান’–কে মনে হত আহা কি অমৃত বাণী! ভাবতাম, বা ভাবতে চাইতাম, না-পাওয়ার যন্ত্রণার মধ্যেও আছে কী এক অদ্ভূত সুখ! আর কবিতারা তো ছিল। অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতাকে কীভাবে অহঙ্কারের অলঙ্কার বানিয়ে গলায় পরা যায় কবিরা খুব ভালো জানতেন। সুনীল যেমন বলেছিলেন,
‘’প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়
আমি মানুষ হিসেবে একটু লম্বা হয়ে উঠি
দুঃখ আমার মাথার চুল থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত
ছড়িয়ে যায়
আমি সমস্ত মানুষের থেকে আলাদা হয়ে এক
অচেনা রাস্তা দিয়ে ধীরে পায়ে
হেঁটে যাই
সার্থক মানুষদের আরো-চাই মুখ আমার সহ্য হয় না
আমি পথের কুকুরকে বিস্কুট কিনে দিই
রিক্সাওয়ালাকে দিই সিগারেট
অন্ধ মানুষের শাদা লাঠি আমার পায়ের কাছে
খসে পড়ে
আমার দু‘হাত ভর্তি অঢেল দয়া, আমাকে কেউ
ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গোটা দুনিয়াটাকে
মনে হয় খুব আপন
আমি বাড়ি থেকে বেরুই নতুন কাচা
প্যান্ট শার্ট পরে
আমার সদ্য দাড়ি কামানো নরম মুখখানিকে
আমি নিজেই আদর করি
খুব গোপনে
আমি একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ
আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার
মাথার পেছনে
আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।
কবিতা, গান বা যে কোনো সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র মনকে নাড়া দিত সহজেই, পলি-কাদা-জলে মাখামাখি মাটির মত বেশ নরম-সরম হৃদয় ছিল তখন। অবলীলায় সবকিছুর ছাপ পড়ে যেত সেখানে। কবিতা থাকতো মুখে মুখে। দুঃখের কবিতা, সুখের কবিতা, প্রেমের কবিতা, কামের কবিতা, রোমান্টিক কবিতা, দ্রোহের কবিতা প্রায় সব ধরনের কবিতা বা কবিতার বই থাকতো হাতের কাছে, মনের চাহিদা ও ইচ্ছার সাথে তাল মিলিয়ে কাব্য-চর্চা অর্থাৎ কাব্য-পাঠ চলতে থাকত। আর ছবি-আকাঁআকি তো ছিলই। আঁকার শুরুতে ভেবে নিতাম কী আঁকবো, কিন্তু পরে সেটা আর প্রায়ই মনে থাকত না। এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় হারিয়ে যেতাম। ধীরতা, স্থিরতা, একাগ্রতাজাতীয় ব্যপারগুলোতে তখনো নিমজ্জিত হয়ে যাই নি। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানার’ মধ্যে নিমঘ্ন ছিলাম অনেক বেশি। এখানকার বেশির ভাগ ছবি তারই সাক্ষ্য বহন করে। অস্থির, উম্মুল, উদভ্রান্ত প্রথম যৌবন। আহা, ফেলে আসা সেই সব দিন, সেই সময়! বড় বেশি ভালোবাসি তোমায়।
শনিবার,
মে ৩০, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ,
করোনাক্রান্তিকাল,
বনশ্রী, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন