আনিসুজ্জামান মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশে এই ধরনের মানুষকে অপছন্দ করে এরূপ মানুষের সংখ্যা কম নয়। তদুপরি, আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাকে অশ্রদ্ধা করবে – এটাও অপ্রত্যাশিত ছিল না। এ-ধরনের কোনো একজন মানুষকে সবাই ভালোবাসবে আমি এটা আশাও করি না। আনিসুজ্জামান প্রগতির কথা বলতেন। আর প্রগতি থেকে পিছনের দিকে যেতে চাওয়া, প্রতিক্রিয়াশীলতাকে ভালোবাসে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা তো দিন দিন বাড়ছে।
এখানে সারাজীবন কুকর্ম করে, দুর্নীতি করে, ঘুষ খেয়েও একজন ব্যক্তি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পাবে যদি সে ধার্মিক হয়, তাহলে তার জন্য প্রাণ দেয়ার লোকের অভাব হবে না। কত চোর বাটপার গুণ্ডা বদমাশ খুনী এখানে জনপ্রিয়, শ্রদ্ধার পাত্র – দেখে হাসি পায়। আর আপনি যদি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, মুক্তচিন্তার কথা বলেন, মানুষের বিকাশের জন্য উদগ্রীব থাকেন, তাহলে আপনাকে ঘৃণা করবে এই ধরনের লোক আপনার আশেপাশেই অসংখ্য পাবেন। ভাববেন না এরা সবাই অশিক্ষিত, এদের মধ্যে সব ধরনের তথাকথিত শিক্ষিত লোকও পাবেন অনেক। এই দেশের মানুষ এখনও যেভাবে আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদদের অপছন্দ করে – কি আর বলবো! যদিও এনাদের লেখা, চিন্তা-ভাবনা, দর্শন অনুধাবন করার জন্য মস্তিষ্কে যে ধরনের গ্রে ম্যাটারের প্রয়োজন তা আদৌ অনেকের মাথায় আছে কি না সন্দেহ। তবে একটু সুবিধাবাদী হলে, একটু তেলবাজ হলে, একটু ধর্মকর্ম করলে, সবার মন যুগিয়ে কথা বললে হু আজাদ, আ শরীফেরও থাকতো অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী। যদিও সারা জীবন ওনারা পরিমাণগত নয়, বরং গুণগত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উদগ্রীব ছিলেন। সেজন্য সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে কখনোই ধাবিত হন নি। বুকের খুব গভীরে ওনারা সত্যকে সত্য, অন্যায়কে অন্যায়, অজ্ঞতাকে অজ্ঞতা বলার সৎ সাহস রেখেছিলেন আমৃত্যু।
জয়া আহসান ধর্ম মানা ও না মানার স্বাধীনতা বিষয়ক আনিসুজ্জামানের একটি উদ্ধৃতি শেয়ার করেছেন। সেখানে বিভিন্ন জনের দেয়া মন্তব্যগুলো পড়লাম। জয়া আহসানকে দারুণ সব গালি-গালাজ দিয়ে অভ্যার্থনা জানানো হচ্ছে! আমি মনে করি এ-রকম মনোভাব পোষণ করে, মন খুলে এভাবে গালি দিতে চায়, এ-ধরনের মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে অগণিত। চক্ষুলজ্জায় অনেকে অনেকে হয়তো এভাবে লেখে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একই মনোভাব পোষণ করে। চারিদিকে এত ধার্মিক মানুষ, নৈতিকতার ধ্বজাধারী মানুষ দেখে খুশী হই। কিন্তু সেই একই সমাজে একই মানুষের ভীরে এত চোর, বাটপার, দুর্নীতিবাজ, ধর্ষণকারী, পরের সম্পদ লুণ্ঠনকারী মানুষ দেখে ফাটা বেলুনের মত চুপসে যায়। এত ভালো মানুষ, নৈতিক মানুষ, ধার্মিক মানুষের ভীরে এরা কারা? উত্তর মেলে না।
আনিসুজ্জামানে আর আমাদের মাঝে নেই। সবাইকে একদিন যেতে হবে। কিন্তু থেকে যাবে তাঁর কীর্তি। জ্ঞানীগুণী মানুষের সংখ্যা এমনিতেই যে কোনো সমাজে কম থাকে। গুণীর কদর যে সমাজে থাকে না, সেখানে গুণী জন্মায় না। আমাদের দেশে মানুষ সংখ্যায় বাড়ছেই শুধু। ১৮/১৯ কোটি মানুষের ভীরে ভালোমানের বিজ্ঞানী, গবেষক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, শিল্পীর সংখ্যা এত নগন্য যে ভাবতেই খারাপ লাগে। এটাও অবশ্য বলে দেয়, আমরা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছি। দু-চারজন যারা ছিল তারা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে, এটা নিয়ে ভাবিত নয়, কারণ এটাই ভবিতব্য। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’। কিন্তু আফসোস শূন্যস্থান পুরণের মত পরিবেশ, পরিস্থিতি বিশেষ দেখছি না। তবুও আশায় বুক বাঁধি। অন্ধকারের বুক চিরে আলো আসবেই। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যতদিন থাকবে, ততদিন তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আনিসুজ্জমান স্যারকে নিয়ে আমার বিশেষ কোনো স্মৃতি নেই শুধু মাস্টার্সের ভাইভার স্মৃতি ছাড়া। ভাইভাতে তিনি আমাকে রবীন্দ্র উপন্যাস ‘গোরা’ থেকে প্রশ্ন করেছিলেন। ‘গোরা’র হারিয়ে যাওয়ার পিছনে যে মিউটিনি বা বিদ্রোহের অনুষঙ্গ ছিল প্রশ্নটা ছিল সে-বিষয়ক - এটা স্পষ্ট মনে আছে। আমি যেহেতু ওনার সরাসরি ছাত্র ছিলাম না, সেহেতু ওনার প্রতি তীব্রভাবে গুণমুগ্ধ হওয়ার কোনো ব্যাপার ঘটে নি। বিভাগে আনিস স্যার যখনই আসতেন একটা সাড়া পড়ে যেত। স্যারকে বিভাগের সব শিক্ষকই খুব ভালোবাসতেন। কেননা, বাংলা বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষকই কোন না কোন না ভাবে স্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। মানুষকে ভালোবাসার, আপন করে নেয়ার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল স্যারের, সেটা বুঝতে পেরেছি। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে স্যার বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তবে তাঁর ‘কাল নিরবধি’ ও ‘বিপুলা পৃথিবী’র গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলাম বরাবরই।
দিন কয়েক আগে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে হারিয়েছি। গতকাল আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে বাংলা কথাসাহিত্যের আরেক দিকপাল দেবেশ রায়ও চলে গেলেন। ওনাদের অবদানের জন্য আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শারিরীক ভাবে না থাকলেও আপনাদের কীর্তিই আপনাদের বাঁচিয়ে রাখবে। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।
শুক্রবার
১৫ মে, ২০২০ খ্রিঃ
করোনাক্রান্তিকাল, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন