মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৩

ডেনিস মুকওয়েগে : একজন দরদী মানুষ


নিজের হাসপাতালে মুকওয়েগে। ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া। 

অনেক দিন ধরে ডেনিস মুকওয়েগে-কে  নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম। প্রথম যখন তাঁর কথা জানতে পারি বিভিন্ন সংবাদ পত্র ও কঙ্গো-র স্থানীয় কিছু রেডিও-র মাধ্যমে, আমার কৌতুহল বেড়ে যায়। সেই থেকে এই মানবতাবাদী ডাক্তার এর সম্পর্কে যে কোনো সংবাদ খুব আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে পড়ার ও শোনার চেষ্টা করতাম।

কঙ্গোর পূর্বাঞ্চল গত এক দশকের অধিক সময় ধ’রে অস্থির ও অশান্ত। গৃহযুদ্ধ আর প্রতিবেশী দেশগুলোর বহুমুখী ষড়যন্ত্র দেশটিকে কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। বেশ কিছু বিদ্রোহী দল দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি কায়েম করে রেখেছে।  দেশটি আয়তনে বিশাল, প্রায় ২৩,৪৫,৪১০ ব কি মি। সরকার ব্যবস্থা বেশ নড়বড়ে। আইনের শাসনের অভাব সর্বত্র। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থাও তথৈবচ। ভালো কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই গড়ে উঠে নি পুরো দেশটা জুড়ে। দেশের সর্ব পশ্চিমে রাজধানী কিনশাসা, আর সর্ব পূর্বে অবস্থিত ওরিয়েন্টাল প্রদেশ। রাজধানী থেকে এই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করতে দুর্বল এই সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। পুরো অঞ্চল জুড়ে ভয়াবহ এক অরাজকতা আজো বিদ্যমান। এই সমস্যা থেকে কবে উত্তরণ পাবে বা আদৌ পাবে কি না, সাধারণ মানুষেরা আজো জানে না। প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে কোনো সৌভাগ্য তো বয়ে আনতে পারেই নি,  বরং এই অঢেল সম্পদ তাদের জীবনে নিয়ে এসেছে অভিশাপ, তাদের সহজ সরল জীবনকে দূর্যোগের  কালো রাত্রিতে ডেকে দুঃস্বপ্নময় করে তুলেছে। এই সম্পদকে কুক্ষিগত করতে দেশি বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠী বেশ সক্রিয়। তাদের লোভের খেসারত  দিতে হচ্ছে এই অঞ্চলে বসবাসরত আমজনতাকে।

যুদ্ধ এখানে নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। উদ্ধাস্তু জীবন তাদের। আজ এখানে তো কাল ওখানে। খোলা আকাশ তাদের মাথার উপরের একমাত্র আশ্রয়। বন জঙ্গল তাদের আশ্রয়স্থল ও নিরাপদ আবাস। তারা আদ্যন্ত প্রকৃতির সন্তান। সুস্থ্য সুন্দর ও মানবিক জীবন নয়, বেঁচে থাকাটাই এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মৃত্যু তাদেরকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে, রাষ্ট্র তাদেরকে কিছুই দিতে পারে নি, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, কিছুই না; রাষ্ট্রের কাছে তারা এখন মনে হয় না আর কিছু দাবী বা আশা করে। কেননা, তার জানমালের দেখভাল যে রাষ্ট্র করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে তার কাছে অন্য কিছু আশা করা একধরনের বাতুলতা।

কিন্তু এত হতাশা আর ঝুঁকির মধ্যেও নিজেদের মানবীয় গুণাবলীর জোরে কিছু মানুষ আপামর জনসাধারণকে সুন্দর ও সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখায়।  

ডেনিস মুকওয়েগে সে-রকম একজন মানুষ। কঙ্গোর মত  যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন অনেকগুলো বছর ধরে। যুদ্ধের সবচেয়ে সহজ  ও নির্মম শিকার হয় নারী ও শিশুরা। নারী ধর্ষণের হার বিবেচনায় আফ্রিকার অন্য দেশগুলোর তুলনায় কঙ্গো বেশ এগিয়ে। মিলিশয়া বাহিনী, বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, এমনকি মাঝে মাঝে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নারীদের নির্যাতিত হওয়া খুব সাধারণ ঘটনা এখানে। এখানে বেশ কিছু মিলিশিয়া ও বিদ্রোহী বাহিনী আছে যাদের আবাসস্থল কঙ্গো-র গভীর অরণ্য। যখন খাদ্য দ্রব্য ও অন্যান্য যাবতীয় জিনিসের অভাব দেখা দেয় বা সরবরাহে টান পরে তারা নিকটবর্তী লোকালয়ে হামলা করে, লুট-পাট করে। হত্যা, লুটপাট ও অপহরণ এখানে নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। আর এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে কিশোরী ও যুবতী মেয়েরা। এই অস্ত্রধারী গ্রুপগুলোর সহজ শিকারে পরিণত হয় তারা। নির্যাতন, ধর্ষণ-এর পাশাপাশি এদেরকে অনেক সময় অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় গভীর জঙ্গলে। টানা কয়েকদিন ধরে চলে শারিরীক নির্যাতন। যৌনদাসী হিসেবে মিলিশিয়ারা তাদেরকে আটকে রাখে দিনের পর দিন। শারীরিক, মানসিকভাবে এরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অমানবিক নির্যাতনের কারণে অনেকের দেখা দেয় মানসিক বিকারগ্রস্ততা ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গোণা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না, দুর্বিষহ জীবন বয়ে বেড়ানো হয়ে উঠে ওদের অধিকাংশের নিয়তি।

দেবদূতের মত এদের পাশে এসে দাড়িয়েছেন ডেনিস মুকওয়েগা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন অনেকগুলো বছর ধ’রে। তার চিকিৎসাসেবা পেয়ে অগণিত কঙ্গোলীজ নারী নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন।

ডেনিস মুকওয়েগে ১৯৫৫ সালে  বেলজিয়ান কঙ্গোতে- যেটি বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাব্লিক অব কঙ্গো নামে পরিচিত - জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশুনা করেছেন চিকিৎসা বিদ্যায়,  কঙ্গো ছাড়াও প্রতিবেশ দেশ বুরুণ্ডি থেকে পড়াশুনা করেছেন। উচ্চ-শিক্ষার্থে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে।  সব অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা দিয়ে নিজের দেশে, নিজের এলাকায় অসহায় সুবিধা-বঞ্চিত, নির্যাতিত  অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। অক্লান্ত শ্রম ও সেবা দিয়ে পাঞ্জি হাসপাতালকে আজ উন্নত মানের রোগ নিরাময় কেন্দ্রে পরিণত করেছে। নিপীড়িতের সেবায় বিশেষ করে ধর্ষিত নারীদের চিকিৎসা দানের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এই হাসপাতাল স্থাপন করেছে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। 

Podiatry  তে বিশেষজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তিনি পরবর্তীতে  gynecology  নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। গ্রামের মহিলাদের কষ্ট ও দূর্দশা দেখে তিনি মনস্থির করেন এদের জন্য কিছু করবেন। সন্তান জন্মদান থেক শুরু বিভিন্ন ধরনের রোগে-শোকে মহিলারা এক অনিশ্চিত ও বিপদজনক জীবন অতিবাহিত করেন। তাদের এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেয়া খুব কঠিন না, শুধু সময়মত সুচিকিৎসা বাঁচিয়ে দিতে পারে এই ধরনের অসংখ্য কঙ্গোলীজ নারীকে। অন্য কারো দিকে না তাকিয়ে নিজেকে সঁপে দেন আর্ত-মানবতার সেবায়। 


লেমেরা হাসপাতালে  তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯ ৮৯ সালে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে যখন প্রথম কঙ্গো ওয়ার  শুরু হয়, এই হাসাপাতালটি যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে নি। অতঃপর তিনি বুকাভু তে চলে যান। সেখানকার চিকিৎসার ব্যবস্থার করুণ অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেন পাঞ্জি (Panzi Hospital ) হাসপাতালে  অপারেশনের  সুবিধাসহ একটা উন্নত মানের ম্যাটারনিটি ওয়ার্ড খোলার। 


ক্রমশ তিনি আবিষ্কার করেন প্রথাগত কিছু রোগ ছাড়াও অত্র অঞ্চলের মহিলা ও কিশোরীরা  ধর্ষণসহ  বিভিন্ন ধরনের  যৌন নির্যাতনের শিকার। আর এদেরকে সুস্থ্য করার মানসে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নেন তিনি। কেননা যুদ্ধের পার্শ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ধরনের নারী নির্যাতনের হার ক্রমশ বাড়ছে। তিনি এবং তার সহকর্মীরা এরি মধ্যে চল্লিশ হাজারের বেশি ধর্ষিতা নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন, যাদের অনেকের অবস্থা ছিল যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। এখনো প্রতিদিন অসংখ্য নারী এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য স্মরণাপন্ন হন, যাদের অনেকের জন্য প্রয়োজন পড়ে জটিল  সব অপারেশনের। ডাক্তার ডেনিস মুকওয়েগে নিজেই প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ জন রোগী দেখেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল রোগীদের এখানে দেয়া হয় বিনামুল্যে চিকিৎসা।  বর্তমানে  ফিস্টুলা হসপিটাল অব আদ্দিস আবাবা-র বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষকদের সহযোগিতায় বিভিন্ন নার্স, ডাক্তারকে ধাত্রীবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে এই হাসপাতলের গুণগতমান ও চিকিতসাসেবার দিগন্তকে আরো প্রসারিত করা হছে। বর্তমানে এই হাসপাতালের বেড সংখ্যা ৪৫০ যার মধ্যে ২৫০ টি যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য সংরক্ষিত। হাসপাতালে কর্মরত জনবল প্রায় ৩৯৮,  বার্ষিক বাজেট ৩'২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।   


ডি আর কঙ্গো-তে ক্রমবর্ধমান গণধর্ষণ ও কিভু প্রদেশে গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে  ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডেনিস মুকওয়েগে  কঙ্গো সরকার সহ  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া সমালোচনা করে বিবৃতি দেন।   মাস খানেক পরে অক্টোবরের ২৫ তারিখে তিনি হামলার শিকার  হন অজ্ঞাতনামা কিছু আততায়ীর হাতে। ভাগ্যক্রমে তিনি বাসায় ছিলেন না বলে প্রাণে বেঁচে যান, তাঁর মেয়েকে বন্দী করে রাখে আততায়ীরা, পরবর্তীতে বাসায় ঢুকার সময় তাঁর উপর আক্রমণ চালানো হয়। ডেনিস মুকওয়েগা জানে বেঁচে গেলেও তার দেহরক্ষী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। জীবনের নিরাপত্তাহীনতা উপলব্ধি করে তিনি ইউরোপ গমন করেন। তার অনুপস্থিতে পাঞ্জি হাসপাতাল-এর যাবতীয় কার্যক্রম ব্যপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিল, সারা দেশের মানুষ তাঁকে ফিরিয়ে আনা এবং নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। বিশ্ব গণ-মাধ্যমও এই খবরকে বেশ গুরুত্ত্ব দিয়ে বিশ্ব-বাসীর মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে।


অবশেষে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ফিরে আসেন নিজ বাসভূমে। কাভুমা বিমানবন্দর থেকে বুকাভু শহর পর্যন্ত প্রায় ২০ দীর্ঘ মাইল রাস্তা জুড়ে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে সম্বর্ধনা জানান।  যাদের অধিকাংশ ছিল  তার কাছে চিকিৎসাপ্রাপ্ত। মুকওয়েগের প্রতি তাদের সীমাহীন ভালোবাসা। তাঁরা বিশ্বাস করেন তাদের বেঁচে থাকা, সুস্থ্য থাকার পেছনে এই লোকটার আছে অমূল্য অবদান। তাই এই মহিলারাই নিজের ক্ষেতের আনারস , শস্য বিক্রি করে তার ফিরে আসার বিমান ভাড়ার তহবিল সংগ্রহ করেন। মানুষের ভালোবাসায় আবার সিক্ত হন এই মহামানব। চোখের আনন্দাশ্রু সংবরণ করে প্রস্তুত হন আবার আর্ত-মানবতার  সেবায় ব্রতী হতে। 


শোনা যাছে এই বছর তিনি পেতে পারেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। এরি মধ্যে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। পুরস্কারের টাকা তিনি ব্যয় করেছেন হাসপাতালের উন্নয়নের কাজে। নোবেল পুরস্কার তার কাজকে আরো উৎসাহিত করবে, যদিও আমি মনে করি না, তিনি পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করেন। তথাপি প্রকৃত ভালো কাজের মূল্যায়ণ অন্য অনেক মানুষকে মানব কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার জন্য প্রেরণা যোগাবে।

তাঁর পাওয়া পুরস্কার ও সম্মাননাগুলোঃ
১। Special Human Rights Prize 2007, ফ্রান্স।  জুন ২০০৮
২। UN Human Rights Prize .  নিউ ইয়র্ক,  ডিসেম্বর ২০০৮
৩। Olof Palme Prize, সুইডেন, ২০০৯
৪। African of the year, নাইজেরিয়া, জানুয়ারি ২০০৯
৫।  Chevalier de la Légion d'Honneur, ফ্রান্স, নভেম্বর ২০০৯
 ৬। The Van Heuven Goedhart-Award, নেদারল্যান্ড রিফিউজি ফাউণ্ডেশন, ২০১০
 ৭। Wallenberge Medal,  মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১০

 ৮। The King Baudouim International Development Parize, মে ২০১১ 
 ৯। Clinton Global Citizen Award, নিউ ইয়র্ক সেপ্টেম্বর ২০১১
১০। Human Rights First Award, ২০১৩

















ডেনিস মুকওয়েগে, ইন্টারনেট থেকে নেয়া ছবি।

**তথ্য-উপাত্তের জন্য উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাহায্য নিতে হয়েছে। 




০৮ অক্টোবর ২০১৩
বুনিয়া, ডি আর কঙ্গো  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন