যাত্রা হলো শুরু
বুনিয়া কঙ্গো-র একটি
ছোট্ট উপশহর। যেদিন প্রথম এখানে পা রাখি, আমার সাথে সাথে চুনিয়া-র কথা মনে পড়ে
যায়। রফিক আজাদের একটি কবিতায় চুনিয়ার কথা আছে। ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’। যদিও এই শহর চুনিয়ার মত
নিষ্কলুষ নেই, রক্তে ভেসে গিয়েছিল এই আধো-মলিন উপশহরের অলি-গলি-পথ। কান পাতলে আজো
শোনা যাবে অযুত মৃতপ্রাণের দীর্ঘশ্বাস এই শহরের আকাশে-বাতাসে।
সেই বুনিয়া থেকে শুরু করলাম আমাদের যাত্রা। চারজনের একটি দল। এক নির্মল সকালে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দু-চোখে নতুন কিছু দেখার আনন্দ। বুনিয়া থেকে এন্টেবি, তারপর সেখান থেকে গোমা, গোমা থেকে কালেমি, কামিনা আর সর্বশেষ গন্তব্য লুবুম্বাসি। বলে রাখা ভালো সুন্দর নামের শহরগুলো দেখতেও ভারি সুন্দর। বুনিয়া থেকে এন্টেবি পর্যন্ত আমাদের ভ্রমণ নিষ্কণ্টক ছিল। সেখান থেকে গোমা পর্যন্তও কোনো গোল বাধেনি। শুধু মাঝখানে বিমান পরিবর্তন করার জন্য কিছুসময়ের জন্য নিতে হয়েছিল যাত্রা-বিরতি।
![]() |
নীল দাগের আশেপাশের জায়গাগুলো ধ'রে আমরা জাম্বিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। MONUSCO-র ওয়েবসাইট থেকে মানচিত্রটি নেয়া হয়েছে। |
সমস্যার শুরু
ঝামেলার দেখা মেলে গোমা
গিয়ে। বিমানে আসন অপ্রতুল এ-অজুহাত তুলে আমাকে আমাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
অনেক অনুরোধ- উপরোধ কর্তব্যরত কর্মকর্তার মন গলাতে ব্যর্থ হয়। সিদ্ধান্ত হয়, আমি
অন্য আরেক রুটে গিয়ে সেখানে রাত্রি-যাপন শেষে পরের দিন সকালের ফ্লাইটে লুবুম্বাসি
যাবো। আর আমার দলে বাকি তিনজন আজই লুবুম্বাসি চলে যাবে।
অবশেষে বন্ধুদেরকে বিদায়
দিতে হলো পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য। আমি গোমা থেকে বুকাভুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। সেই
যাত্রা ছিল যথারীতি আতঙ্ক ও এডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ। আবহাওয়া ছিল কিছুটা খারাপ আর 'বিচ
২৯' এই ছোট্ট আমেরিকান বিমানে চড়া ছিল আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। বিমানের আমেরিকান
পাইলট ছিলেন অসম্ভব সাহসী। আমরা যাত্রী ছিলাম পাইলট ও কো-পাইলটসহ মাত্র ৯ জন। আমার জীবনে
স্মরণীয় কিছু ভয় পাওয়ার ঘটনা আছে। এটি তার মধ্যে অন্যতম।
অবশেষে প্রায় ৪৫ মিনিট
ফ্লাইং শেষে বুকাভু বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম। এগুলো আসলে ঠিক বিমানবন্দরের সংজ্ঞায়
পড়ে না। খুবই ছোট। এয়ার ফিল্ড বা এয়রা স্ট্রিপ বলাই সঙ্গত। কঙ্গো-র স্থল যোগাযোগ খুব
করুণ হলেও এই দেশে প্রায় ৪৫০টির বেশি এয়ারফিল্ড আছে। কেন এত এয়ারফিল্ড এই দেশে সে
গল্প অন্য আরেকটা লেখায় করার আশা আছে।
বুকাভু-র নিস্তব্দ রাত
পাহাড়ের উপর ছোট্ট একটা
ক্যাম্পের মত জায়গায় যখন অন্ধকারের ছামিয়ানা ঘিরে ফেলেছিল চারপাশ আমি পাহাড়ের
চুড়ায় এসে চুপটি করে রাতের আকাশ দেখতে থাকি। ভ্রমণে আমি এইধরনের একা সময় কাটাতে খুব
পছন্দ করি। পৃথিবীর এই দুর্গম প্রান্তরে কোনোদিন আমি আসি নাই,হয়তো আর কোনোদিন
এখানে আসা হবে না। এই যে খণ্ড রাত্রির অমলিন স্মৃতি, নিজের সাথে নিজের কথা বলা, এ-এক
অদ্ভূত অনুভূতি! জানি বহু বহুদিন পর হয়ত আমার মনে পড়বে এইসব অমেয় স্মৃতি। জীবনে
আমার প্রাপ্তি তেমন কিছু নেই উল্লেখ করার মত, কিন্তু এই যে মুহূর্তগুলো, আমার
একান্ত প্রিয়-সময় এগুলোই আমাকে বেঁচে থাকার রসদ যোগায়। এগুলো কানে কানে এসে বলে যায়
বেঁচে থাকা সুন্দর, জীবন অমূল্য, স্মৃতিরা দূর্লভ-রতন। সময়কে অপচয়িত হতে দিও না,
কুড়িয়ে নাও চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীবনের মণি-মাণিক্য।
পরের দিন খুব সকালে
মৃদু-কুয়াশা গায়ে মেখে আমার পরবর্তী গন্তব্যর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। যাত্রী অল্প।
সময়ও বেশি লাগে না; আমাদের বিমান আকাশে উড়াল দেয়।
কঙ্গো-র প্রকৃতির প্রেমে
আমি এরি মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। এত সুন্দর দেশ! পাহাড় আছে এখানে। সবুজ অরণ্য আছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট 'ইপুলু'-র অবস্থান এই
কঙ্গো-তে। পাহাড়ের গা-ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলছে ছোট্ট ছোট্ট কতসব নদী। কঙ্গো-তে আছে
মিঠাপানির হ্রদ। আলবার্ট লেক। আছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ তাংগানিকা লেক।
এখানে আছে বিখ্যাত পিগমি উপজাতি। আছে ওকাপি-র মত দূর্লভ প্রাণী। এখানে লোকেরা কথা
বলে ৪৫০ টির মত ভাষায়। আর আছে বিচিত্র সব উপজাতি। এত বৈচিত্রে ভরা স্থানকে ভালো না
বেসে পারা যায়!
লুবুম্বাসি কঙ্গো-র অন্যান্য শহরের তুলনায় কিছুটা সমৃদ্ধ
শহর। বেশ শান্ত আর নিরিবিলি শহর। কঙ্গো-র গৃহযুদ্ধের আঁচ এখানে খুব বেশি লাগে নি।
অনেক বিদেশি আছে এই শহরে। পর্যটন শহর হিসেবে লুবুম্বাসির খ্যাতি আছে।
জাম্বিয়া-র ভিসা হওয়ার
আগ পর্যন্ত এখানে থাকতে হবে আমাদের। থাকার একটা ভালো ব্যবস্থা হয়ে যায়। এখন শহর দেখার পালা। ঘুরতে থাকি শহরের আনাচে কানাচে। এখানে ম্যালাকাইট
নামক আগ্নেয় পাথরের বিভিন্ন রকম অলঙ্কার পাওয়া যায়। সেগুলো সংগ্রহ করি। টাইগার্স
আই-এর অলঙ্কারও বেশ বিখ্যাত। অদ্ভুত সুন্দর সেই পাথরের সন্ধানও পেয়ে যায়।
ত্রিশ/চল্লিশ ডলারে বেশ মনোহর কিছু মালা আমাদের মনে ধরে। কিনে ফেলি। ব্যতিক্রমি ও দূর্লভ হওয়ার কারণে উপহার হিসেবে এটা যে
বেশ প্রশংসিত হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বড় একটা তামার খনির আছে এই এলাকায়। তামার তৈরি বিভিন্ন শিল্প-কর্ম চোখে
পড়ে। দুই-চার পিস ব্যাগকে ভারী করতে থাকে...
অতঃপর জাম্বিয়া
ভিসা সংগ্রহ করে
জাম্বিয়াতে প্রবেশের প্রস্তুতি নেই।
সড়ক পাথে জাম্বিয়াতে
প্রবেশ করি। ১২ জানুয়ারি ২০১২। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ। দুপুর দেড়টায় কঙ্গো-র
সীমান্ত অতিক্রম ক’রে জাম্বিয়াতে প্রবেশ করি। একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া ক’রে
সীমান্তের নিকটবর্তী শহর কিটওয়ে-র উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। দুপুরের রৌদ্রতাপ তত প্রখর ছিল না। রাস্তার
দু-পাশে সবুজের ছড়াছড়ি। নির্মল বাতাসে শ্বাস নেই প্রাণ ভ’রে। নীল আকাশের সাদা মেঘ
আমাদের অভ্যর্থনা জানায় জাম্বিয়ার মাটিতে
কিটওয়ে শহরে যখন পৌঁছি
তখন মধ্যাহ্নের সূর্য পশ্চিমাকাশে অনেকটুকু হেলে গেছে। আর একটু পরে - এই ছোট্ট
শহরের অলিগলি অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে যাবার আগে - রাস্তার সড়কবাতিগুলো জ্বলে
উঠবে। সেই রকম ক্রান্তিকালে আমরা বাস কাউন্টার খুঁজে বের করি। বহুল প্রতীক্ষিত
লিভিংস্টোন শহরের বাস-টিকেট হাতে আসার সাথে সাথে আমাদের চোখ-মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত
হয়ে উঠে।
হাতে যেটুকু সময় আছে সেই সময়টা কাজে লাগানো যায় কিটওয়ে শহরটা ঘুরে দেখে। এই বিষয়ে দেখা গেল সবাই একমত। শহরটা বেশ ছোট। সীমান্তবর্তী উপশহর। নিরিবিলি। পরিছন্ন। তবে চাকচিক্য নেই খুব একটা। কিছু সরকারি দালান-কোটা, ব্যাংকবীমার অফিস, দুই-একটা পার্ক, কয়েকটা স্কুল-কলেজ এই নিয়ে কিটওয়ে শহর। লোকজন যথেষ্ট ভদ্র, অমায়িক। আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম, কারণ আমাদের মধ্যবর্তী যাত্রাবিরতির স্থান হবে জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা, সেখানে সব ঠিক থাকলে আমার গভীর রাতে পৌঁছাবো। কাজেইে সেখানে খাবার-দাবার ঠিক ভাবে না পাওয়ার সমূহ সম্ভবনা আছে। কাজেই উদরপূর্তির কাজটা কিটওয়ের মাটিতে সেরে ফেলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে – এই বিষয়ে সবাই একমত হলাম।
রাত ৮ টার বাসে আমরা
উঠলাম। বাস প্রায় আধাঘণ্টা দেরি করে ছাড়লো। বাসের গুণগত মান আমাদেরকে সন্তুষ্ট
করতে পারলো না। বুঝতে পারলাম বাস জার্নিটা খুব বেশি আরামদায়ক হবে না। খুব সংকীর্ণ
আসন, কিছুটা অপরিছন্ন ও গন্ধযুক্ত। আসনগ্রহণ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। নিদ্রাদেবী
আমার প্রতি কিছুটা প্রসন্ন ছিল বলে মনে হল, লুসাকা পর্যন্ত একটা ভালো মানের একটা
ঘুম দিতে পেরেছিলাম।
প্রায় আধাঘন্টার
যাত্রাবিরতি দেয়া হলো লুসাকায়। তখন রাত বেশ গভীর। স্টেশনের আশে-পাশে প্রচুর মানুষ
ঘুমাচ্ছে; অনেকটা আমাদের দেশের রেলস্টেশন এর মত। এইরকম রাত্রিকালীন স্টেশনে টং এর
দোকানের চা খাবার তৃষ্ণাটা অনুভূত হলো। আমাদের দেশের মত চা-এর কোনো ব্যবস্থা চোখে
পড়লো না। রুটি-কলা আর পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করলাম, আবার একটা দীর্ঘ বাস
জার্নির মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলাম।
ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেল, জাম্বিয়ার বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর আমাদেরকে আবারো মুগ্ধ করলো। এত সবুজ, এত স্নিগ্ধ প্রকৃতি দেখে মনটা ভালো লাগায় ভ’রে গেল।
লিভিংস্টোন শহরে যখন বাস এসে থামে তখন সূর্য প্রায় মধ্যাকাশে। আমাদের প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে একটু দেরিতে এসে পৌঁছালাম। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো শহর লিভিংস্টোন। বিখ্যাত পরিব্রাজক ডেভিড লিভিংস্টোন এর নামানুসারে এই শহরের নামকরণ করা হয়। আজকের এই লিভিংস্টোন একসময় গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। বন্য জীবজন্তুর অভয়ারণ্য ছিল, আর ছিল আদিমতর আদিবাসী মানুষের নিরাপদ নিবাস। কালের বিবর্তনে আর তথাকথিত সভ্যতার ছোঁয়ায় লিভিংস্টোন শহর এখন আর ঘুমায় না। কয়েকশো বছর আগেও হয়তো রাত্রির নিকষ কালো অন্ধকা্রে এখানে ঘুরে-বেড়াত কত-শত নাম না জানা প্রাণী। এই দুর্ঘম পাহাড়-অরণ্যে কোনো লুটেরা কিংবা ধূর্ত বণিকের পা পড়ে নি তখনো, মানুষের পদপাতে ভারী হয়ে ওঠে নি এখানকার নির্মল বাতাস। পাখির কলকাকলী আর বন্যপ্রাণীর বিচিত্র ডাকের সাথে 'মোসি ওয়া তুনিয়া'-র (Mosi oa Tunya: The smoke that thunders - ভিক্টোরিয়ার ফলস-এর পূর্ব নাম, স্থানীয়রা এখনো এই নামে ডাকে)। কুল কুল ধ্বনি এখানে কী যে মধুর অপার্থিব জগত তৈরি করত ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। এই বুনো, আদিম ও অকৃত্রিম পরিবেশ বেশিদিন বজায় থাকে নি এখানে। ডেভিড লিভিংস্টোন যখন এখানে প্রথমে পা রাখে, পানির শব্দ অনুসরণ ক'রে সে যখন সেই বিশালকায় পড়ন্ত স্রোতের সামনে দাঁড়ায় বিস্ফারিত চোখে, সেই দৃশ্য কল্পনা ক'রে আমি কতবার শিহরিত হয়েছি! লিভিংস্টোন এক অদম্য সাহস আর দৃঢ় মনোবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছিলেন আফ্রিকা অভিযানে। ধর্ম-প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে বের হলেও ভ্রমণ এবং নতুন জায়গা আবিষ্কারের রোমাঞ্চ ছিল তাঁর শিরা-উপশিরায়। সেই রোমাঞ্চের নেশায় সারা আফ্রিকা চষে বেড়িয়েছিলেন লিভিংস্টোন। তাকে নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও পৃথিবীর অন্যতম সেরা পরিব্রাজক মনে করা হয় তাঁকে।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন