বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০

মায়ের গল্প


মায়ের হাসিমাখা উচ্ছল মুখ খুব বেশি মনে পড়ে না। মায়ের আনন্দের, উৎসবের উপলক্ষ্য হত খুবই সীমিত। কিংবা উৎসব আনন্দে মায়েরা হয়ে যেত কর্মী, অন্যদের আরামকে শতভাগ নিশ্চিত করার মধ্যেই তারা সুখ বা আনন্দ খুঁজে নিত বা নিতে হত! শুধু বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় আমার মা কিশোরী হয়ে যেতেন, বালিকা-উচ্ছলতা মাকে পেয়ে বসত। মার সেই সুখী সুখী মুখ আমি কখনো ভুলবো না। দু-তিন মাইলের গ্রামীণ মেঠো রাস্তা পায়ে ডিঙিয়ে যখন বাপের বাড়ির দরোজায় পৌঁছতেন, মায়ের সেই হাসিমুখ আরো দ্বিগুণ প্রসারিত হত। কোলে এক সন্তান, আর অন্য হাতে আরেক সন্তানকে ধরে রেখে দীর্ঘপথ হাঁটার পরেও মাকে ক্লান্তি বিশেষ স্পর্শ করত না। মা যখন তার বাবার বাড়ি এসে পৌঁছতেন, মনে হত স্বর্গের সদর দরজায় পা রেখেছেন। কিংবা কে জানে, স্বর্গের দ্বারেও মা এত সুখী ও আনন্দিত হতেন কি না! এখনও বাপের বাড়ির কথা শুনলে মা-র চোখ-মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মা-র বাবা-মা তো বটে, ভাইরাও কেউ এই ধরাধামে নেই এখন। কিন্তু 

 মায়ের কাছে ‘বাবার বাড়ি’ মানেই অনেক অনেক দিন আগে রেখে আসা তার রূপসী মায়ের মুখ, কঠিন-কোমল বাবার ছায়া, ডানপিটে ভাইদের স্নেহাদর, তার আস্ত একটা দূরন্ত শৈশব, বাল্য আর কৈশোরের সোনাঝরা দিন। এইসব স্মৃতিই আসলে মায়েদের হৃদয়ের খুব গভীরে লেপ্টে থাকে চিরদিন। কারণ বিয়ের পর তারা আসলে নিজের সেই আগের বাড়িতে ফিরতে পারে না, সেখানে তার মতো অন্য কোনো নারী সে-অভাব পূরণ করে ফেলে। মা যখন মামাবাড়ি যেত, আমার মনে হত মা তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে হাতড়াতে যেতো। মা আসলে তার ফেলে আসা দিনের স্মৃতিকে সম্বল করে এক করুণ আবেগ ও অভিমানে ছুটে যেত সেখানে। প্রতিবার বাপের বাড়ি থেকে আসার সময় মা-র বাঁধ ভাঙা কান্নায় আকাশ-পাতাল প্রকম্পিত হত, বিয়ের দিন যে-কান্নার সূত্রপাত হয়েছিল, সেটা এই কিছুদিন আগেও এমনকি যখন মা তার মেয়েরও বিয়ে দিয়েছেন, তখনও তার সেই কান্নাভারাতুর বেদনা এতটুকু কমে নি, প্রকাশ-ভঙ্গিতে হয়তো একটু পরিবর্তন এসেছে। আমি প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম, মায়ের পা-দুটো জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আমার নিজেরও কান্না পেত খুব। পরে বুঝে গেছি, এটা অপরিবর্তনীয়, হতেই থাকবে। ভেবে অবাক হতাম, নিজ বাড়ির জন্য মায়ের এত আবেগ, এত ভালোবাসা!

কিন্তু আমি জানতাম, মা-র আসলে নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। মা-রা আসলে অন্যদের জন্য বাড়ি করে দেয়। মা-দের কারণে ইট-কাঠের বাড়িরা ‘ঘর’ হয়ে যায়। সেই ঘরে সবাই সুখে দিনাতিপাত করে। কিন্তু মা? আমার বাবার সংসারে মা ছিলেন বিরামহীন কর্মী। মা-র আক্ষরিক অর্থেই কোনো বিশ্রাম ছিল না। সংসারের ঘানি টানতে টানতে মা-র কটিদেশ সেই যে ন্যুব্জ হয়েছে তা আর সোজা হয় নি। ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ সবই আমার মা-কে করতে হত, অন্য অনেক মায়ের মতো। আমার কিশোরী মা কপালে সিঁদুর আর মুখে ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে মাটি লেপা মেঝের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই কবে কোন এক অঘ্রানের বিষণ্ণ লগনে আমার বাবার ঘরে আলো ক’রে ঢুকেছিল, সেই দিনটির কথা আজ কারো মনে নেই। সেই যে যুদ্ধ, সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তা আর পিছু ছাড়ে নি মাকে। জীবন সংগ্রামে মা-কে কখনো ক্লান্ত হতে দেখি নি, মার কোনোদিন ছুটি ছিল না, ছিল না অবসর। আমাদের অনেকগুলো পিঠাপিঠি ভাই-বোনকে মানুষ করতে করতে কখন যে কিশোরী বধূ থেকে অশীতিপর বৃদ্ধায় পরিণত হয়েছেন টেরই পান নি। আসলে জীবন তাকে এত নিদারুণভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, দায়িত্বের বেড়াজালে কখন যে লীন হয়ে গিয়েছেন, নিজেকে নিয়ে ভাবার মত বিলাসী সময় তার আর বের করা হয়ে ওঠে নি।

মা-র স্মৃতিরা আজ শরবিদ্ধ হরিণীর মত এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। মা-র মুখে ভাষা আছে, কিন্তু সেগুলো আজ বেশিরভাগ সময় বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না। মার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব অসীম মহাশূন্যে কিংবা ইথারে ঘুরে বেড়ায়, মার স্মৃতিরা একমাত্রিকতায় পর্যাবাসিত, সব স্থির। মার স্মৃতিগুলো মার কাছেই এখন পাথরে খোদাই হায়রোগ্লিফিক্সের মত -অস্পষ্ট আর ধাঁধাময়। সেগুলোতে এখন নতুন করে রঙ আর আবেগের মিশেল সম্ভব নয়। মা-র কাছে ঘড়ি বা সময়, দিনপঞ্জি বা মাস-তারিখ-বার এখন অনেকটাই তাৎপর্যহীন। আমার মা সারাজীবন জয়ী ছিল, দুঃখ-দারিদ্র্য-বঞ্চনা আর বাবার অসুস্থতার মধ্যেও মা ছিল অসীম সাহসী যোদ্ধা। আমি জানি, এই গল্প শুধু আমার মায়ের নয়, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন, এমন অসংখ্য মায়েদের দেখা পাওয়া যায়, যাবে। মানব-সভ্যতা কোনো শিক্ষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, পয়গম্বর বা অবতারেরা তৈরি করেন নি বা টিকিয়ে রাখেন নি। বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, পৃথিবীর সব মায়েরা বস্তুত এই সভ্যতার ধারক ও বাহক। আমার মা-র ব্যবস্থাপনা দক্ষতা তার বিএ এম এ পাশ সন্তানেরা সারা জীবন চেষ্টা করলেও খুব সামান্যই আয়ত্ত করতে পারবে। তাঁর শিক্ষিত সন্তানদের আজ একটা কি দুইটা সন্তান পালতে গিয়ে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত; মানুষ করা তো আরো অনেক পরের ব্যাপার। আর আমার স্কুল-কলেজ-পাশহীন মা কী অবলীলায়, কী দক্ষতায় আট আটটি সন্তানকে মানুষ করেছেন, আমি অবাক হয়ে শুধু ভাবতেই থাকি। বাবার অর্থনৈতিক ভূমিকা বা ইত্যকার বিষয়গুলোকে গৌণ করছি না, কিন্তু মায়েদের সংগ্রামগুলো আলাদা, অন্যমাত্রার। মাকে আমরা কখনো কোনো পুরস্কার দেই নি, কোনো সম্মাননা দেই নি। আসলে মাকে দেয়ার মত প্রতিদান এই পৃথিবীতে আজো তৈরি হয় নি। আমি যা-ই দেয়ার কথা ভাবি, কী যে ক্ষুদ্র সে-প্রচেষ্টা, বস্তুগত অর্থে কী যে অর্থহীন মায়ের সেই নিঃসীম ভালোবাসার কাছে। ফেসবুকে ছবি দিয়ে, মাকে নিয়ে দু-চারটা বাক্য লিখে মায়ের মহত্ত্বের, ত্যাগের অতি অতি সামান্যও প্রকাশিত হয় না। মায়ের পাশে থাকলে এখন, লিখে এই সময় অপচয় না করে মায়ের পাশে বসে থাকাটাকেই শ্রেয়তর মনে করতাম।

যে মায়ের স্তন্য পান করে আমরা তার সন্তানরা আজ হৃষ্টপুষ্ট, বলশালী শরীর নিয়ে বাতাসের বিপরীতে মাথা উঁচু ক’রে হেঁটে যাই, সে মায়ের শরীর আজ ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর। যে মায়ের হাত ধরে চারপেয়ে জীব থেকে দু’পেয়ে জীবে পরিণত হয়েছি, যে মা-র আঁচল ধরে আমরা হাঁটতে শিখেছি সদর্পে, আমার সে-মা আজ হাঁটতে গেলে তাঁর সেই সন্তানদের খুঁজেন। হাঁটতে গেলে, দাঁড়াতে গেলে মার ভগ্ন শরীর ভারসাম্য রাখতে পারে না, মা হাত বাড়িয়ে দেয়, হাতড়াতে থাকে। মা এভাবে হাত আগেও বাড়াতেন, তখন হাত বাড়িয়ে দিতেন তার সন্তানদের দিকে, তার সন্তানদের জন্য, তাদের আশ্রয় হ’য়ে। মার হাত ধরার জন্য সে-সন্তানরা আজ খুব একটা পাশে থাকে না, থাকতে পারে না, থাকা হয়ে ওঠে না। যে-মা আমাদের চব্বিশ ঘণ্টায় দেখে রাখত পারতেন, রাতে ঘুমের মধ্যেও তার শিশু-সন্তানের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে যেতেন, সেই মায়ের পাশে আমরা কতক্ষণ থাকি তা ভাবলে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। আমাদের সেই শূন্যস্থানে, মায়ের সেই নিঃসঙ্গ হাতে, শোভা পায় হাত তিনেক উচ্চতার কাঠের লাঠি। কখনো কখনো ঘরের দেয়ালেরা সন্তান হয়ে মাকে পিঠ বাড়িয়ে দেয়। কাঠের ক্ষীণকায় লাঠি আর কংক্রিটের দেয়ালরা আজ মায়ের সন্তান, অনেক বড় আশ্রয়। আলজেইমারের আক্রান্ত মা আজ কিছুই মনে রাখতে পারেন না। অথচ স্মৃতিভ্রংশ রোগে মা সব ভুললেও আজো তার সব সন্তানের নাম বলতে পারেন, অন্য কারো চেহারা মনে রাখতে না পারলেও আমার মা তার সব কয়টি সন্তানকে চিনতে ন্যানো সেকেন্ডেরও কম সময় ব্যয় করেন। কিছুদিন আগেও প্রত্যেকটি সন্তানের জন্মের মাস-দিন-ক্ষণ চোখের পলক পড়ার আগে বলে দিতেন। মা এখন খুব খুব সীমিত কথা বলেন। মা এখন আর রামায়ণ মহাভারতের গল্প গড়গড় করে বলে যেতে পারেন না, মা এখন ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে’ ব’লে ব’লে ঢুলু ঢুলু চোখে সন্তানের শিয়রে আধশোয়া হয়ে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অপত্য স্নেহে কাতর হয়ে বলেন না - বাবা ঘুমিয়ে পড়, সকালে তোরে মজার একটা খাবার দেব। সে সবের প্রয়োজন আজ ফুরিয়েছে। কিন্তু আজো মায়ের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কানে বাজবেই মায়ের কাতর কণ্ঠ - ‘যাদু, ভাত খাইছত্তি? তোরে এইরম রোগা রোগা লাগেকা? মুখ হুন্না অই রইছে কা?’


মা এখনও আমাদের নিয়ে চিন্তা করেন, চিন্তা করতে করতে মা-র ভগ্ন শরীর আরো দুর্বল হয়ে যায়, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। বয়সজনিত কারণে বিছানা একটু নোংরা হলে মা খুব অসহায় বোধ করেন। আমরা মাকে সাহায্য করতে গেলে মা খুব বিব্রত বোধ করেন। মা ভাবেন - আমার কারণে সন্তানদের কী যে কষ্ট হচ্ছে! মাকে যতই সাহস দিই, ভরসা দিই, মা তবুও খুব মিইয়ে যান, একধরনের অপরাধবোধে ভোগেন। তার সন্তানদের কষ্ট-পরিশ্রম আজো তাকে এই বয়সেও পীড়া দেয়। মাঝে মাঝে আফসোস করেন, আমাদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারেন না বলে, শারিরীক অক্ষমতার কারণে আমাদের দেখা-শুনা করতে পারেন না বলে তার বুক জুড়ে এক আকাশ শূন্যতা। মাঝে মাঝে ভগবানকে ডেকে তাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেন। বলেন - মা হয়ে যেহেতু সন্তানের দেখভাল করতে পারি না, বেঁচে থেকে কী লাভ!
মার কাছে অত অন্যায় করেছি, মাকে কত কষ্ট দিয়েছি, কত অবাধ্য হয়েছি কিন্তু মা কোনো দিন ঘুণাক্ষরেও অভিশাপ দেয়ার কথা ভেবেছেন বলে মনে হয় নি। তীব্র কষ্টেও মা তার সন্তানদের অমঙ্গল হোক - এমন কিছু চান নি, করেন নি, বলেন নি! দুই একটা ব্যতিক্রম ছাড়া, পৃথিবীর সব মায়েরা আত্মত্যাগের এক সীমাহীন শক্তি নিয়ে পৃথিবীকে, এই মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়ে যান। সন্তান লালন-পালনের মত কঠিন কাজকে সভ্যতার সেই আদিযুগ থেকে মায়েরা করে এসেছেন। মায়েরা সর্বশক্তির আধার। মায়েদের ভেতরেই থাকেন দেবীরা কিংবা দেবীদের ভেতর মা। আজকের কর্মজীবী মায়েদের দেখলে একথার সত্যতা আরো বেশি মেলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মায়ের কখনো প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা পান নি। হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছিলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহীদের নাম মা’। মায়েদের শ্রমের মূল্য আজো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজে স্বীকৃত নয়। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার অভিশাপ থেকে মায়েরা মুক্ত হোক। পৃথিবীর সব মায়েদের জন্য ভালোবাসা। সব মায়েরা ভালো থাকুক, দীর্ঘজীবী হোক।

মে ১৬, ২০২০ খ্রিঃ
শনিবার, করোনাক্রান্তিকাল,
বনশ্রী, ঢাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন