বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২০

লেক ভিক্টোরিয়া - শীতল হ্রদের শান্ত হাওয়া

লেক ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়া হ্রদ। কতশতবার এই লেকের পাড়ে এসে বসেছি তার ইয়ত্তা নেইকতগুলো বিষণ্ণ বিকেল, মনোমুগ্ধকর মূহুর্ত এই লেকের জল-হাওয়ার সাথে মিশে গিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সে হিসাব আজ আর কেউ করবে না উগান্ডার বাতাস বেশ বিশুদ্ধ, আবহাওয়া সারা বছর বেশ চমৎকার, সবসময় একটা বসন্ত বসন্ত ভাব। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কঙ্গো-তে কাজ করতে করতে ক্লান্ত আমরা উগান্ডায় এসে ছুটি কাটাতাম, আর উগান্ডা মানে আমার কাছে লেক ভিক্টোরিয়া। লেকের দু-তীরের ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের কর্মক্লান্ত, গৃহকাতর মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিত। উগান্ডায় আমাদের ডেরা ছিল বাংলাহাউজ, এন্টেবি বিমানবন্দর থেকে বেশ কাছে, আর আমদের এই ডেরার বেশ কাছেই ছিল লেক ভিক্টোরিয়া। রুম থেকে বের হলেই - অন্য কোন স্থানে বিশেষ কোনো কাজে না গেলে- লেক ভিক্টরিয়াই ছিল আমাদের অন্যতম গন্তব্য। মিনিট দশেক হাঁটলে লেকের নিকটতম পাড়ে আমরা পৌঁছে যেতাম। 
বিখ্যাৎ পর্যটক ও অভিযাত্রী জন হানিং স্পিক ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়ার নামে এই হ্রদের নামকরণ করেন। স্থানীয় নাম ছিল নিয়ানযা হ্রদ। স্পিকের গাইডই লেকটিকে প্রথমবার এই নামে পরিচয় করিয়ে দেয়। সেটা ১৮৫৮ সালের দিকের ঘটনা। নীল নদের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে স্পিক তার ভ্রমণসঙ্গী ও আরেক বিখ্যাত অভিযাত্রী রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনসহ এই হ্রদের তীরে এসে পৌঁছান একদিন। স্থানীয় লুগান্ডা ভাষায় এই হ্রদের আরো একটি নাম আছে, এন্নালুবালে। আনুমানিক ৫৯,৯৪৭ বর্গ কিলোমিটারের এই হ্রদ আয়তনের দিক থেকে আফ্রিকার বৃহত্তম, আর ট্রপিক্যাল বা গ্রীষ্মপ্রধান দেশের হ্রদ হিসেবে পৃথিবীর বৃহত্তম। সুপেয় পানির উৎস বিবেচনায় এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম, প্রথম স্থানে আছে উত্তর আমেরিকার সুপিরিয়র হ্রদ। এই হ্রদের সর্বোচ গভীরতা আনুমানিক ২৬৬ ফুট এবং গড় গভীরতা প্রায় ১৩০ ফুটের মত। কেনিয়া, তানজানিয়া এবং উগান্ডা তিন দেশ জুড়েই এই হ্রদের অবস্থান, যার সিংহ ভাগ পড়েছে তানজানিয়ায়, প্রায় ৪৯ ভাগ; উগান্ডা এবং কেনিয়াতে পড়েছে যথাক্রমে ৪৫ এবং ৬ ভাগ।

নিজেকে আমি একটা বিশেষ কারণে ভাগ্যবান মনে করি, মাযিওয়া মাকূ বা আফ্রিকান গ্রেট লেকগুলোর বেশিরভাগই আমার দেখার সুযোগ হয়েছে শুধু লেক মালাবি, লেক এডওয়ার্ড এইরকম দুয়েকটি ছাড়া। তবে মালাবি হ্রদ না দেখলেও এর উৎস নদী অর্থাৎ মালাবির সবচেয়ে বড় নদী সায়রে যেটি আবার জাম্বেজি নদীর সাথে সংযুক্ত সেই নদী দেখার সুযোগ হয়েছিল। অন্য প্রধান হ্রদগুলো লেক তাংগানিকা, লেক আলবার্ট এবং লেক ভিক্টরিয়া এই তিনটিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। লেক আলবার্টে বোটে করে ঘুরেছিলাম একবার। এসব হ্রদের মাছের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। লেকগুলোতে প্রচুর তেলাপিয়া মাছ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন ফিস নামে বেশ বড়সড় একজাতীয় মাছ পাওয়া যেত, আমাদের খাবার মেন্যুতে প্রায়ই থাকত, আকৃতিতে বড় হলেও স্বাদে বিশেষ রসনাবিলাসী ছিল না।

লেক ভিক্টোরিয়ার পাড়ে সময় কাটানোর জন্য আছে অনেকগুলো ছোট-বড় রেস্তোরাঁ। বিকেল বেলায় লেকের পাড়ে বসে লেকের তাজা মাছ-ভাজি খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল অনেকবার। সাথে থাকে আফ্রিকান কলা-ভাজি। ভাজি না বলে এটাকে কলার কাবাব বলাই ভালো। আফ্রিকার প্রায় সব দেশেই এই কলার বিশেষ খাবারটি খুব জনপ্রিয়। আর সাথে বিখ্যাত নাইল বেল লেজার বা ক্লাব পিলস্নার কিংবা প্রিমু জাতীয় উগান্ডান বিয়ারে চুমুক দিলে পুরো বিকেলটি অন্যরকম হয়ে যেতে পারে। সাধারণত রেস্তোরাঁর বাহিরে লেক-লাগোয়া তীরে টেবিল-চেয়ার সাজানো থাকে। উপরে উন্মুক্ত আকাশ, সামনে লেকের বিশাল জলরাশি, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, পাখিদের ওড়াওড়ি, মৃদুমন্দ হাওয়া সব মিলিয়ে অন্যরকম পরিবেশ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও বিরক্তি আসার সুযোগ কম। রেস্তোরাঁর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং লেকের তীরবর্তী এলাকা যথেষ্ট দীর্ঘ ও প্রশস্ত হওয়ার কারণে তেমন ভীর থাকে না বললেই চলে। নিরিবলি ও নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এই লেকের প্রতি অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে। আমার সবচেয়ে প্রিয় লেকসমূহের কথা যদি বলতে হয় তাহলে সর্বাগ্রে এই 'লেক ভিক্টোরিয়া-র' নাম আসবে। আমার একান্ত কাটানো অসংখ্য স্মৃতি যেমন আছে তেমনি দলবেঁধে হৈ-হুল্লোর করার ঘটনাও বিরল নয়। কঙ্গো-তে কাজ করতে করতে যখন ক্লান্ত, একঘেঁয়েমি তাড়ানোর জন্য আমাদের প্রিয় স্থান ছিল উগান্ডাউগান্ডা-তে যুদ্ধ নাই, আমাদের দৈনন্দিন মিশন-সম্পর্কিত দুর্ভাবনা নাই, মিটিং নাই, কনফারেন্স নাই, পিটি নাই, গেমস নাই; বলা যেতে পারে যা আছে একান্ত নিজের কিছু ব্যক্তিগত সময় উগান্ডায় এসে অনেকে আমরা স্রেফ ঘুমাতাম, একটু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম, সমমনা দুয়েকজন মিলে সন্ধ্যাবেলায় বারে বসে হালকা পানাহার করতাম কালে-ভদ্রেকিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো লেক ভিক্টোরিয়ার পাড়ে গিয়ে বসে থাকতেলেকের পাড়ে ছিল পার্কের মত বসার জায়গা, রেস্টুরেন্টে বসতে না চাইলে নির্জন সেইসব স্থানেও বসা যায়আমি একেক সময় একেক জায়গায় গিয়ে বসতামমন ভালো হয়ে যেতনিঃসঙ্গ সময় কাটাতামঅদ্ভুত এক ভালোলাগায় মন প্রশান্তিতে ভ'রে ওঠতো
চোখ বন্ধ করলে আজো চোখে ভাসে সে সব দৃশ্য। বাতাসে লেকের জলে হালকা ঢেউ ওঠতো। দূরের মাছ ধরা নৌকাগুলো দুলতো ঢেউয়ের তালে তালে। মাছ শিকারের আশায় লেক জুড়ে উড়ে বেড়াত সাদা বক। দেখেছি ডাহুক ও পানকৌড়ির মত পাখিও। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ এবং লেকের জলের মৃদু কলকল ধ্বনির সম্মিলিত সঙ্গীত কানে বড় মধুর হয়ে বাজত। এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব সুর। অপূর্ব ও অমলিন। সম্মোহনের সে সুর মনের ভেতর আজো বয়ে যায়চোখ বন্ধ করে মাঝে মাঝে চলে যায় সেই সুদূরে। কান পাতলে সেই সুর, সেই সঙ্গীত শ্রবণেন্দ্রিয়কে মোহিত করে। আমি আচ্ছন্ন হয়ে সেই সুর সাগরে ডুবে থাকি।

























কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন