রুমে ফিরে মোবাইল
ফোন হাতে নিয়ে অবাক হলাম। অনেকগুলো মিসড কল দেখাচ্ছে। নাম্বারটা দেখে মনে পড়ল আজ
জঁভিয়ের এর দেখা করতে আসার কথা ছিল।
প্রতিদিনের মত আজো রুমে মুঠোফোনটা রেখে অফিসে চলে গিয়েছিলাম।জিনিসটার প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। এই দূরদেশে সচরাচর কারো ফোন পাওয়া বেশ বিরল ঘটনা। কালে ভদ্রে দেশ থেকে দুই একটা কল যে পাই না তা নয়, কিন্তু কখন সেই রিং টোন বাজবে আর তার আশায় সারাদিনমান এই মূর্তিমান সমস্যাটাকে পকেটে বহন করার কোনো মানে হয় না।
আমার চোখে ভেসে
উঠলো বিষণ্ন এক যুবকের ছবি। জীবন সংগ্রামের ক্লান্তি আর বেদনা যাকে নিঃশেষ করে
দিতে চাচ্ছে।
জঁভিয়ের এক স্বাপ্নিক যুবক। তার ছোট্ট দু’টি কালো চোখের ভেতরে রঙিন সব স্বপ্ন খেলা করে। জানুয়ারির কোনো এক বিষণ্ন বৃষ্টিমেদুর মন খারাপ করা সকালে ও এসেছিলো এই নির্মম পৃথিবীতে।জন্মেই দেখেছে ক্ষুব্দ স্বদেশ, স্বৈরশাসকের বুটেরতলায় প্রতিদিন পিষ্ট তার প্রিয়তম মাতৃভূমি।যে তাদেরকে দেখেয়িছিলো বিপ্লবের স্বপ্ন, একটা সুন্দর ও শোষণহীন সমাজে বেড়ে উঠার আশা তাঁর নির্মম মৃত্যু সেই আলোকিত স্বপ্নের সৌধ অমানিশার অন্ধকার গহবরে তলিয়ে যেতে থাকে। চারিদিকে এতো যে সবুজ প্রকৃতি, করুণ সব স্নিগ্ধ পাহাড়; তার মাঝে বেড়ে উঠার যে আনন্দ, জঁভিয়ের তা পেয়েছি কিনা আমি জানি না, তাকে কখনো জিজ্ঞাসা করা হয় নি। কিন্তু যেই তার সাথে আমার সখ্য হয়, আমি নিদারুণ সব দুঃখের মুখোমুখি হই। ওর হাসি হাসি মুখের আড়ালে কত যে বেদনার ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে তা হয়ত আমার কোনোদিনও জানা হতো না, যদি ওর মনের ভাব প্রকাশ করার বাহনটার সাথে আমার অপরিচয় থাকতো।
শিক্ষাবঞ্চিত
অধিকাংশ মানুষ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে ফেলে অভাবের কারণে নয় অধিকন্তু বেশীরভাগ সময় তারা জানে না
জীবনকে কীভাবে সাজাতে হয়। ঈশ্বরের প্রতি যদিও অবিচল ও অটুট বিশ্বাস লালন করতে তাদের
কার্পণ্য নাই, তথাপি
ঈশ্বরের আনুকূল্য তাদের ভাগ্যে কদাচিৎ জোটে, ঈশ্বর তাদের
দিকে মুখ তুলে তাকানোর সময় খুব কম ই পান।
নিয়তির করুণ
খেলায় জঁভিয়ের সেরূপ এক দূর্ভাগা পিতাকে জন্মদাতা হিসেবে জেনে এসেছে। মুখে বোল ফোটার আগে সে জেনে গেছে অভাব কী
জিনিস, দারিদ্র্য কাকে
বলে।
ঘরে অনেকগুলো
হাভাতে মুখ, কিন্তু
খবার নাই। বাপ তার জন্ম দিতে আলস্য করে নি, কিন্তু ক্ষুধা
মিটাতে তার অপগারতার সীমা পরিসীমা নাই। বড়ো আরামপ্রিয় মানুষ তিনি।
কৈশোর আসার আগেই
তাকে সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিতে হয়। পরিবারে অনেকগুলো মুখ, আদরের সব ছোট ভাইবোন, পেটে তাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, ওদের অসহয়তা ওর
সংবেদনশীল মনকে খুব নাড়া দেয়। ওর খুব মায়া হয় নিষ্পাপ এই শিশুগুলোর জন্য। কিন্তু
ছোট্ট দু’টির হাতের কিই বা করার আছে।
ওইটুকুন বয়েস থেকে সে জেনে গেছে নিয়তি তাকে সহজে ছেড়ে দেবে না। সে নিজেকে প্রস্তুত করে বর্বর এই পৃথিবীতে এক অসম যুদ্ধে লড়ে যেতে। ক্ষুধা আর দারিদ্র পারে নি তার মুখের অমলিন হাসি কেড়ে নিতে। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাত্রা করার যে অদম্য শক্তি সে সঞ্চয় করছিলো কৈশোরের অন্তিম পর্যায়ে, যৌবনের প্রারম্ভে তা স্বতঃধারায় উৎসারিত, এতুটুকু ভাটা পরে নি সে উচ্ছ্বলতায়। সে স্কুল পেরিয়ে কলেজের চৌহদ্দিতে পা রাখার দুঃসাহস দেখিয়েছে, একটি বহুজাতিক মোবাইল কোম্পনিতে নামমাত্র বেতনে সেলসম্যান হিসেবে উদয়াস্ত শ্রম বিক্রি করেও সে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত নয়। শোষণ, বঞ্চনা আর হরেক রকম নির্যাতনকে পায়ে দলে সে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এক নতুন স্বপ্নময় দিনকে বাস্তবে রূপ দিতে।
================================
জানুয়ারি ২০১২
বুনিয়া, ডি আর কঙ্গো
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন