বুধবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৮

মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন ভালো শিক্ষকের গুণাবলী


ভূমিকাঃ

‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটি বহুলচর্চিত ও আপ্তবাক্য হলেও তা যে সর্বাংশে সত্য সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণকারীর সংখ্যা নেহাতই নগন্য। আর এই শিক্ষার সাথে জড়িত বা শিক্ষা-সেবার  সাথে জড়িত বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি হলো শিক্ষক-সমাজ। দক্ষ শিক্ষক সমাজ যে-কোনো জাতির জন্য আশির্বাদস্বরূপ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একজন ছাড়া অন্যজনের অস্ত্বিত্ব প্রায় অর্থহীন বলা চলে। বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে  অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। নিম্ন-মাধ্যমিক স্তরের পরের এবং উচ্চ-মাধ্যমিকের আগের স্তরটিকে মাধ্যমিক স্তর হিসেবে অভিহিত করা হয়। নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এই দুই ধাপে তিন প্রকারের শিক্ষাক্রম চালু আছেঃ মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩১৬ টি সরকারি ও ১৬০০৩ টি বেসরকারি বিদ্যালয়ে প্রায় ৮৩১০৪৯৭ অধ্যয়নরত আছে। কোনো সন্দেহ নেই এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীরাই আগামীর দেশ-চালক। এদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা আর দেশ-পরিচালনার জন্য দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলা সমার্থক। আর এদেরকে সার্বিক অর্থে সম্পদ হিসেবে করে তোলার জন্য চায় একদল আধুনিক, দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকগোষ্ঠী।
 দক্ষ-শিক্ষক ও শিক্ষকের দক্ষতা কোনো স্থান ও কাল নিরপেক্ষ ধারণা নয়। নিরন্তর চর্চার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক একটি বিশেষ বিষয়ে ও বিশেষ শ্রেণীর জন্য দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। এই ধরনের দক্ষতার নির্ধারণে কিছু প্রচলিত ধারণা ও পদ্ধতি বিদ্যমান। তবে এই পদ্ধতিগুলোর পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত। আমি এখানে প্রচলিত ও ক্ষেত্রবিশেষে ইতিবাচক  ভুমিকারাখা কিছু পদ্ধতি, ধারণা ও কলা-কৌশলের আলোকে একজন মাধ্যমিক শিক্ষকের শিক্ষণ পরিকল্পনার স্বরূপ উন্মোচন করবো।
যদি শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট উপাদান ও অনুষঙ্গের কথা চিন্তা করি সর্বাগ্রে আসবে শিক্ষার্থী-র নাম। তারপর অবশ্যই শিক্ষক। এবং এরপর অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপাদান ও বিষয়াদি। কাজেই বুঝা যাচ্ছে শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং শিক্ষকের এই গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনের জন্য দরকার সুসমন্বিত শিক্ষণ পদ্ধতি ও পরিকল্পনা।

শিক্ষকের করণীয়

উন্নত ও আধুনিক শিক্ষা-ব্যবস্থায় শিক্ষকদেরকে হতে হয় যথেষ্ট কৌশলী ও পারঙ্গম। শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনা, পাঠ-পরিকল্পনা, বিষয়-ভিত্তিক পাঠ-উপাদান, ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষক যত বেশি দক্ষ হবেন, তার শিক্ষাদান পদ্ধতি ততবেশি কার্যকর ও অনুপ্রেরণাদায়ক হবে। শিক্ষার্থীর সামনে দাঁড়াবার আগে অবশ্যই একজন শিক্ষক নিজেকে জিজ্ঞাসা করবেন তিনি আজকের পাঠদানের জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত কিনা। শিক্ষক যদি অপ্রস্তুত থাকেন, শিক্ষক যদি তার কর্মপদ্ধতিতে সুশৃঙ্খল ও গোছানে না হন, তিনি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হওয়ার সমূহ সম্ভবনা ধারণ করেন। একজন শিক্ষার্থী সাধারণত একজন শিক্ষককে তার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কাজেই মেধা ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষককে অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়। সময়ানুবর্তিতা, উন্নত ও সুদৃঢ় নৈতিক চরিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পোশাক-পরিচ্ছদও ইত্যাদি বিষয়েও তাকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হয় কেননা এর সাথে তার সাফল্য, দক্ষতা, ও জনপ্রিয়তার যোগসূত্র পরিলক্ষিত হয়।
শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু
আগেই বলেছি শিক্ষণ প্রক্রিয়া একজন শিক্ষকের গুনগত মানের উপর নির্ভর করে। একজন শিক্ষক চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত দক্ষতর করে গ’ড়ে তোলেন। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। শিক্ষা ও শিক্ষণ পদ্ধতি কোনো কিছুই আগের মত স্থির নেই। ক্রমশ বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুরানো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা নিজেই নতুনতর নিয়ম ও পদ্ধতিকে স্বাগতম জানাচ্ছে। বিভিন্ন মতবাদে আসছে বিপুল বৈচিত্র‍্য। চিন্তা-ভাবনায় আসছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। শুধু পাঠ্যবই, শ্রেণীকক্ষ আর চক-ডাস্টার নিয়ে পাঠদানের দিন আর নেই। নতুনতর প্রযুক্তি জীবনব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। শিক্ষকও এইসব প্রপঞ্চের বাহিরে নয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাকেও হতে হবে আধুনিক। নিত্য-নতুন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যুগের এই চাহিদার সাথে তাকেও এগিয়ে যেতে হবে। একজন ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের বৈশিষ্ট কিছু শব্দ ও বাক্য দিয়ে সঙ্গায়িত করা কঠিন। তথাপি মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে আমরা একজন ভালো শিক্ষকের গুণাবলী নির্ধারণ করতে পারি।
Screenshot-2017-10-5 Different Teaching Methods A Panacea for Effective Curriculum Implementation in the Classroom Science [...](1).png

চিত্র ১, একজন ভালো শিক্ষকের গুণাবলী Vikoo 2003

শিক্ষণের সংজ্ঞা

শিক্ষণ এমন একটি প্রচেষ্টা যার মধ্য দিয়ে মানুষ তার শিখন প্রক্রিয়ায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনয়ন করেন। শিক্ষণ আচরণ ও সামর্থ্যের এমন এক পরিবর্তন সাধন করেন যেটা তাকে উন্নততর জীবন-ব্যবস্থা ও জীবন-ভাবনা পেতে প্ররোচিত করে। মানুষ-কে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। শিক্ষাকে মনে করা হয় একটি অভিনব অস্ত্র তার সংগ্রামের পথে। শিক্ষণ প্রক্রিয়া তাকে সাহায্য করে কার্যকরী ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত করতে। শিক্ষণের মধ্যে দিয়ে আমরা আধুনিক সমাজে পেতে পারি একজন দক্ষ, জ্ঞানী ও কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক। শিক্ষণের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞান আহরণ ও তার প্রয়োগে পারদর্শী হয়। কোনো কিছু বুঝতে পারা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ও তার মূল্যায়ণ ইত্যাদি শিখতে পারে। বিশেষ অভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়া ছাড়াও তা তার দৃষ্টিভঙ্গি-কে উন্নত করে।শিক্ষাদান পদ্ধতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রফেসর রাস্ক বলেছেন, The process of establishing and maintaining contract between the pupil and subject matter. শিক্ষণ পদ্ধতি মূলত শিক্ষার উদ্দেশ্যমুখী বিভিন্ন কৌশলগুলোর সমন্বয়কে বোঝায়।

শিক্ষণের উপাদানসমূহ

কার্যকরী ও সফল শিক্ষণের কিছু বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের বিবরণ দেয়া যেতে পারে। শ্রেণীকক্ষে একজন শিক্ষকের সাফল্য নির্ভর করে তিনি শিক্ষাদানের যাবতীয় পদ্ধতিগুলো নিয়ে ভাবছেন কিনা। প্রত্যেক শিক্ষকের শৈলী ও কর্মপদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন রকম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দিনশেষে শিক্ষার্থীরা কী শিখছেন, কতটুকু শিখছেন, শিক্ষায় তারা কতটুকু আনন্দলাভ করছেন, জ্ঞান লাভে তার উদ্ধুব্ধ হচ্ছেন কিনা সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা পুরো কর্মযজ্ঞটাই নির্ভর করছে শিক্ষার্থীদের মুল উদ্দেশ্যে ব্যত্যয় না ঘটিয়ে নিত্যনতুন জ্ঞানের আলোয় কিশোর মন-কে বিকশিত করা।
শিক্ষণের পুরো প্রক্রিয়া তিনটা প্রধানে ধাপে ভাগ করা যেতে পারেঃ
ক) প্রস্তুতিঃ শিক্ষক  শ্রেণীকক্ষে যা শিখাবেন এবং পাশাপাশি অন্য যে কোনো কার্যক্রমের যাবতীয় পরিকল্পনা আগেই করে রাখবেন এবং সে অনুসারে নিয়মমাফিকভাবে কিছু অনুশীলনও করতে পারেন।
খ) বাস্তবায়নঃ এই পর্যায়ে শিক্ষক তার পাঠ পরিকল্পনা আক্ষরিক অর্থে শ্রেণীকক্ষে বাস্তবায়ন করবেন। তিনি যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন, যে-পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সামনে বিষয়বস্তু তুলে ধরার কথা ভেবেছিলেন তা ঠিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনাও এই পরিকল্পনার অংশ।
গ) মূল্যায়ণঃ বাস্তবায়ন শেষে তার মূল্যায়ণ জরুরি। শিক্ষক বুঝার চেষ্টা করবেন তার শিক্ষণ পদ্ধতি যথেষ্ট কার্যকরী কি না। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে তারা কতটুকু বুঝেছেন তা অনুমান করতে পারেন। নিতে পারেন কিছু ছোট-খাট পরীক্ষা। তাদের সমস্যা কোথায় হচ্ছে সেটা চিহ্নিত করে তার পরিকল্পনা ও পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারেন।
একটি ছকে কার্যকরী শিক্ষণ পদ্ধতির উপাদানগুলো দেখানো যেতে পারে।
Screenshot-2017-10-5 Different Teaching Methods A Panacea for Effective Curriculum Implementation in the Classroom Science [...].pngচিত্র ২ 
কার্যকরী শিক্ষণের উপাদানসমূহ  - Awotua- Efeboo 2001

শিক্ষণ পরিকল্পনা

ক) নিয়মতান্ত্রিকতা
শ্রেণীকক্ষে একটি সুন্দর, গোছানো ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ কার্যকরী পাঠদানের পূর্বশর্ত। পাঠদানের পাশাপাশি আরো কিছু কাজ থাকে যেমনঃ বাড়ির কাজ আদায় করা, কিংবা বাড়ির কাজ মূল্যায়ণ শেষে ফেরত দেয়া, শিক্ষার্থীদের সমস্যা শোনা, ইত্যাদি বিচিত্ররকমের কাজ পাঠদানের পাশাপাশি করতে হয়। এইসকল কাজের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা শিক্ষক আগে থেকে ব’লে দিতে পারেন পাশাপাশি তাদেরকে সেগুলোতে  অভ্যস্ত করাতে পারেন। বিশৃঙ্খল শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক কম মনযোগী থাকেন। মনোনিবেশে বিঘ্ন ঘটলে শিক্ষার্থীদের কোনো কিছু শিখানো অনেক কঠিন হ’য়ে পড়ে। অনেক অমনোযোগী শিক্ষার্থী এই ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরো বেশি বিশৃঙ্খলা করার মত পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করেন। কাজেই শিক্ষককে এইসব বিষয়ে সজাগ থেকে কার্যকরী পাঠদানের প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে।


খ) প্রত্যাশিত ব্যবহার

শিক্ষককে অবশ্যই সকল শিক্ষার্থীর আচরণগত দিকটিকে গুরুত্বের সাথে খেয়াল করবেন। তিনি শিক্ষার্থীদের যত বেশি বুঝতে পারবেন তত বেশী কার্যকরভাবে তাদের-কে তাঁর শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভূক্ত করতে পারবেন। একটি শ্রেণীকক্ষে বিভিন্ন মেধার ও মানের শিক্ষার্থী যেমন থাকে তেমনি আচরণগত দিকে থেকে বিচিত্র ধরনের শিক্ষার্থীর সম্মুখীন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কাজেই সবাইকে কার্যকরভাবে পাঠদান একটি কঠিন কাজ। শিক্ষক যদি এই বিষয়টি মাথায় রাখেন তাহলে শ্রেণীকক্ষের যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি খুব কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের আচরণগত বিষয়টি মাথায় রেখে কীভাবে তাদেরকে অধিকতর মনোযোগী রে শ্রেণীকক্ষের পরিবেশকে আরো কার্যকর   পারস্পারিক সহযোগিতামূলক করা যায় শিক্ষক তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিতে পারেন।

গ) সবকিছু গুছিয়ে রাখা

একজন ভালো শিক্ষক সুশৃঙ্খলভাবে তার যাবতীয় শিক্ষা-উপকরণ গুছিয়ে রাখবেন। বইপুস্তকের বাহিরে বিষয়ানুসারে একজন শিক্ষকের বিভিন্নধরনের উপকরণের দরকার হয়। শিক্ষার্থীদের তথ্য, তাদের নামধাম, তাদের কার্যকলাপ, তাদের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি বিষয় শিক্ষক নোট রাখতে পারেন। শিক্ষার্থীদের অভিবাবককে প্রয়োজনীয় বিষয়ে কিংবা তার সন্তানদের পাঠ-অগ্রগতির ব্যাপারে একটা পরিচ্ছন্ন ধারনা দিতে পারেন। তাছাড়া নিজেও কোন শিক্ষার্থীর কী ধরনের চাহিদা, কাকে কীভাবে কার্যকর পাঠদান করা যায় তার পরিচ্ছন্ন ও গোছানো পরিকল্পনা প্রণয়ণ করে কর্মক্ষত্রে অভাবনীয় সাফল্য পেতে পারেন।
 
ঘ) উপদেষ্টা নির্বাচন

শিক্ষক যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সেখানকার কোনো অভিজ্ঞ শিক্ষকের সাহায্যে নিতে পারেন। অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান তাদের কাছে পাওয়ার সম্ভবনা থাকে। শিক্ষা-প্রতিষ্টানের লিখিত নিয়ম-কানুনের বাহিরে অনেক অলিখিত নিয়ম-কানুন থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্কেও একটা পরিচ্ছন্ন ধারনা পাওয়া যায়।  আপাতদৃষ্টিতে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও এই ধরনের কার্যক্রম একজন শিক্ষকের সময় বাঁচিয়ে তাকে মূল কার্যক্রমে অধিকতর মনোনিবেশে সহায়তা করে।

ঙ) লেকচার প্রদান

যেকোনো বিষয় শিক্ষার্থীদের অবহিত করার অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি। শিক্ষক পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে নির্দষ্ট বিষয়বস্তুর উপর শ্রুতিগ্রাহ্য ও নান্দনিকভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। শিক্ষককে অবশ্যই খেয়াল রাখতে তার উদ্দিষ্ট শ্রোতা কারা। তার শব্দ-চয়ন থেকে শুরু করে বিষয় বিশ্লেষণে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন শিক্ষার্থীর মধ্যে আগ্রহ জাগায়। তাদের মনঃসংযোগ যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় সেজন্য বিষয়বস্তু মজাদার ও আগ্রহোদ্দীপক করে উপস্থাপন করা জরুরি। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই বয়সের এমন একটা স্তরের মধ্য দিয়ে যায় যেটা বেশ সংবেদনশীল। মাধ্যমিকে পড়া শিক্ষার্থীরা বয়ঃসন্ধির এমন এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি পার করেন যা তাদেরকে সবসময় একটা শারিরীক ও মানসিক সংকটের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়। শিক্ষককে এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে যথেষ্ট কৌশলী ও সংবেদনশীল হতে হবে।

চ) আলোচনা

আলোচনার মাধ্যমে জ্ঞানের প্রসারণ ও ভাগাভাগি যে কার্যকর একটা পদ্ধতি তা সর্বজনবিদিত। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত খুলছে জ্ঞানের নতুন দরজা। কোনো শিক্ষার্থী যখন জটিল বিষয়বস্তু বুঝতে অসমর্থ হন  সে একই বিষয় যখন আলোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় তখন তা অত্যন্ত সহজ ও সরল হিসেবে প্রতিভাত হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেড়ে যায়। আলোচনায় শিক্ষক সচেতনভাবে শিক্ষার্থীদের চিন্তাজগতকে উস্কে দিতে পারেন।  

ছ) প্রশ্নোত্তর পর্ব

প্রশ্নোত্তর এর মাধ্যমে  শিক্ষার্থীর ভাবনা ও চিন্তার জগত পরিশীলিত হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে প্রণোদনা জোগাবেন প্রশ্ন করার জন্য। বলা হয়ে থাকে  উত্তর দেয়ার চেয়ে প্রশ্ন করা কঠিন। কথাটি আদতে মিথ্যা নয়। শিক্ষার্থী তখনি যথার্থ প্রশ্ন করতে সমর্থ হবেন যখন তিনি পঠিত বিষয়টির বোধগম্যতার স্তর অতিক্রম করবেন। কাজেই শিক্ষক প্রশ্ন শুনেই বুঝতে পারবেন শিক্ষার্থী সীমাবদ্ধতা এখনো কতটুকু বিদ্যমান। সে অনুসারে তার শিক্ষণ পদ্ধতি পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করতে পারেন।   
জ) অনুশীলন

যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের একটাই পদ্ধতি সেটা হলো অনুশীলন, আর তার বিকল্প সেটা হলো অধিকতর অনুশীলন। ‘Practice makes perfect’ – কাজেই পৌনঃপুনিক পঠন-পাঠন একজন শিক্ষার্থীকে  আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ হিসেবে গ’ড়ে তুলবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা খুঁজে বের ক’রে সেই বিষয়গুলো বারবার অনুশীলন করার জন্য প্ররোচিত করবেন পাশাপাশি তদারকি করবেন তারা আশানুরূপভাবে অগ্রসর হচ্ছেন কি না। অনুশীলন যেন শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমিতে আক্রান্ত না ক’রে তার জন্য অনুশীলন পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করবেন।


ঝ) চিন্তার আলোড়ন (brain storming)

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মুখস্থ বিদ্যার মত সনাতন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে চিন্তার করার জন্য এই কৌশল সবিশেষ কার্যকরী বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন। যে কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মতামত দিতে বলবেন। শিক্ষক নিজের মতামত না চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিবেন তাদের চিন্তা-ভাবনা সবার সাথে ভাগাভাগি করার জন্য। এই ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনে শিক্ষককে বেশ সচেতন ও কৌশলী হতে হবে। বর্ণনামূলক বা বিশ্লেষণমূলক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের খোলাখুলি মতামত দিতে বলবেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘স্বাধীনতা’ বলতে শিক্ষার্থী কী বুঝেন না জিজ্ঞাসা ক’রে ‘স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব’ বিষয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা কী সেটা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ‘বদ্ধ বিষয়’-এর তুলনায় ‘মুক্ত-বিষয়’-এর দিকে শিক্ষকের পক্ষপাতিত্ব থাকবে। মাধ্যমিকের বিষয় বা স্তর অনুসারে প্রশ্ন করা সমীচীন হবে। শিক্ষককে সবসময় মাধ্যমিকের একজন শিক্ষার্থীর চিন্তার পরিপক্কতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। শিক্ষার্থীর ভাবনা-চিন্তার স্তরকে  শিক্ষক অবশ্যই তাদের স্তর অনুসারে বিচার করবেন এবং সেই হিসেবে মূল্যায়ণ করবেন। তাদের জানাশোনার পরিধি, মেধার পরিপক্কতা নির্ণয়ে শিক্ষক কৌশলী ও বিবেচক হবেন। শিক্ষক যদি মনে করেন কিছু শিক্ষার্থী তাদের চিন্তার স্বাভাবিক ও সাধারণ স্তর থেকে অগ্রগামী সেটাকে ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করবেন। তবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ভাবনা-চিন্তার স্তর কে বোঝার চেষ্টা ক’রে কারা তুলনামূলক বেশি পিছিয়ে আছে, তাদের সীমাবদ্ধতার কারণগুলো নির্ধারণ ক’রে সেভাবে কর্মপদ্ধতি ও শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা করবেন।
উপরে উল্লিখিত শিক্ষণ পদ্ধতিগুলোর সংক্ষেপিত ছক নিম্নে প্রদর্শিত হলোঃ
The Taxonomy of Instructional Techniques
Teacher Focused
  • Direct Instruction: Teacher explains or demonstrates
  • Drill and Practice: Repetition to hone a skill or memorize information
  • Lecture: Teacher provides information to students in a one-way verbal presentation
Dialogue Oriented
  • Question and Answer: Requires reflection as information is exchanged in response to a question
  • Discussion: An exchange of opinions and perspectives
Student Focused
  • Mental Modeling: Assists students in managing their own learning by modeling a problem-solving technique
  • Discovery Learning: Uses students’ personal experiences as the foundation for building concepts
  • Inquiry: Allows students to generate the questions that they will then investigate and answer
ছক ১, শিক্ষণপদ্ধতির শ্রেণীবিন্যাস

উপসংহার

শিক্ষণ পদ্ধতি প্রত্যেক শিক্ষকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, পঠন-পাঠন, জানার পরিধি ইত্যাদির সমন্বয়ে পরিপুষ্টি লাভ করে। শুধু পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নির্মাণ করে আদতে কোনো সাফল্য আসবে যদি না শ্রেণিকক্ষে তারা যথাযথ প্রয়োগ না ঘটে। শিক্ষক-শিক্ষকের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, পারস্পরিক যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানসাধনা ও বিদ্যাশিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটে।

তথ্যসূত্র
১। ড আব্দুল মালেক ও অন্যান্য (২০১৭) , শিক্ষাবিজ্ঞান ও বাংলাদেশের শিক্ষা, র‍্যামন পাবলিশার্স
৩। Theresa Ebiere Dorgu. Different Teaching Methods: A Panacea for Effective Curriculum Implementation in the Classroom. International Journal of Secondary Education. Special Issue: Teaching Methods and Learning Styles in Education. Vol. 3, No. 6-1, 2015, pp. 77-87. doi: 10.11648/j.ijsedu.s.2015030601.13

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন