সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে এখানে আলোকপাত করা হয়েছে।
একাডেমিক গবেষণা, পাঠদান, শিক্ষক-রাজনীতি, ছাত্র-রাজনীতি, শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ
ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাতের পাশাপাশি এর উত্তরণের কিছু উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে কোনো দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে,
সে- বিষয়টি উঠে এসেছে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার মাননিয়ন্ত্রণে ও কার্যক্রমের তদারকি করছে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। উচ্চশিক্ষা প্রসারে কমিশনের ইতবাচক পদক্ষেপগুলো আলোচিত হয়েছে। বলা হয়েছে ব্যর্থতাগুলোও। উচ্চশিক্ষা দেশের
সামগ্রিক উন্নয়নে কীভাবে ভূমিকা রাখে সে-বিষয়ও ফুটে ওঠেছে। এছাড়া উচ্চশিক্ষা
ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে দেশের সামগ্রিক বিপর্যয় যে রোধ করা যাবে না তা বিভিন্নভাবে
এসেছে। উচ্চশিক্ষায় কেন বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন তারও যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা
আছে।
প্রারম্ভিক কথা
বাংলাদেশ পৃথিবীর
অন্যতম জনবহুল দেশ। এখানে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা-সংক্রান্ত অত্যন্ত বৃহত এক
কর্মযজ্ঞ। জনসংখ্যার বিশাল এক অংশ
অধ্যয়নের সাথে জড়িত - প্রাক-প্রাথমিক থেকে
উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, বিশাল এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষা-ব্যবস্থাকে সুসংহত
রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে আরো এক বিশাল পেশাজীবী শ্রেণি। এখানে আমি সে-বিষয়ে
বিস্তারিত না ব’লে শুধু উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আমার আলোচনাকে সীমিত রাখবো।
বাংলাদেশের বর্তমান
প্রেক্ষাপটে উচ্চ-মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষা পাশের পরে সাধারণত উচ্চশিক্ষা
অর্জনের ধাপ শুরু হয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ স্নাতক (সম্মান)-কে উচ্চশিক্ষার
প্রান্তিক ডিগ্রী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রী-কে
বলা হচ্ছে বিশেষায়িত ডিগ্রী। যারা উচ্চ-শিক্ষায় শিক্ষকতায় বা গবেষণায়
নিয়োজত হবেন তারা এই ডিগ্রী অর্জন করবেন। অন্যদের ক্ষেত্রে চার বছরের স্নাতক
সম্মান ডিগ্রীকে সমাপনী ডিগ্রী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ-ক্ষেত্রে সম্মান সমমানের
অন্যান্য ডিসিপ্লিনের ডিগ্রিও একইভাবে বিবেচিত হবে। কাজেই উচ্চশিক্ষার পরিসর
ব্যাপক এই বিষয়ে সন্দেহ নেই। সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়,
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, এবং জাতীয় বিশ্ববিদালয়ের
অধিভূক্ত বিভিন্ন কলেজ থেকে অনার্স পাশ করা শিক্ষার্থীরা সবাই উচ্চশিক্ষার সমাপনী
ডিগ্রি সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার প্রান্তিক ডিগ্রি অর্জন করেছেন ব’লে অভিহিত হবেন।
এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সাথে সমন্বয় করে ফাজিল ও কামিল পাশদেরও
একই মাপকাঠিতে বিচার করা হবে। বর্তমানের ফাজিল ডিগ্রিকে ২ বছর থেকে ৪ বছর মেয়াদি
ও কামিল-কে ২ বছরের পরিবর্তে এক বছর করে সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সমন্বয়
করার প্রক্রিয়া চলছে।
উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০
এ বলা হয়েছে ‘ উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জ্ঞান সঞ্চারণ ও নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন এবং
সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা’। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে সেই স্থান যেখানে
নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে, বহুমূখী
মৌলিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান ও গবেষণা জাতীয় অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে'। হবে
নিত্যনতুন জ্ঞান-দিগন্তের সম্প্রসারণ। আধুনিক বিশ্বের সাথের তাল মিলিয়ে আমরাও
পারবো এগিয়ে যেতে। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের উপযোগী
বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক ও দূরদর্শী মানবদরদী প্রগতিমুখী সুনাগরিক
সৃষ্টি হবে। উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য যদি ব্যর্থ হয় তাহলে জাতি ঘোর অমানিশায় নিমগ্ন
হবে। আধুনিক পৃথিবীতে টিকে থাকতে মেধা, মননে ও সৃজনে অগ্রগামী হতে হবে। সেজন্য
গুণগত মানের উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই। উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমাদের আশার কথা শুনিয়েছেন
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান,
বিডিনিউজ২৪ডটকম-এ দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের
উচ্চশিক্ষা শুরু হয়েছিল চারটি সাধারণ ও দুটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে।
বর্তমানে এটা বেড়ে পাবলিক,
প্রাইভেট মিলিয়ে
১৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত
হয়েছে। এর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আছে দুই হাজার ২০০ এর বেশি
কলেজ। এসব উচ্চশিক্ষা বা টারশিয়ারি লেভেল এডুকেশন পাচ্ছে প্রায় ৩২ লাখ ছেলে-মেয়ে যা ইউরোপের বেশ কিছু উন্নত দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো তথ্য হল, আমাদের ১৬ কোটি জনগণের এক-তৃতীয়াংশই কোনো না কোনো পর্যায়ের শিক্ষায় নিয়োজিত আছে। এর
অর্থ হল, উচ্চশিক্ষার উপর চাপটা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বই কমবে না।
যেহেতু আমাদের ৪০ ভাগ জনসংখ্যাই ২৬ বছর
বা তার নিচে, আমাদের জনগণ বিশ্বের
অন্যান্য অনেক অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি
কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল। এটা আমাদের বিরাট একটা সম্ভাবনা যা তাদের
জনসম্পদে রূপান্তরিত করে বাস্তবায়ন করা যায়। আর এ জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই’।
উচ্চশিক্ষা যে-কোনো
দেশে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ ধাপ। বাংলাদেশও তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। তবে উন্নত
দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের শিক্ষার মৌলিক পার্থক্য কম থাকলেও গুণগত
বিচারে বের হয়ে আসবে যোজন যোজন ফারাক। উচ্চশিক্ষায় আমাদের অবস্থান এখনো খুব বেশি
শোচনীয় না হলেও খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে নেই, একথা স্বীকার করতে আশাকরি
অধিকাংশেরই বাধবে না। কেন আমরা শিক্ষা ব্যবস্থায় দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়ন সাধন করতে
ব্যর্থ হচ্ছি? কেন আমাদের উচ্চশিক্ষা বিশ্বমানের হয়ে ওঠছে না? প্রতিবছর নতুন নতুন
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, কিন্তু বিশ্ব র্যাঙ্কিং এ নেই বাংলাদেশের প্রাচীন ও প্রথম
সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামও? কেন? এই সকল প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে
আমাদের উচ্চশিক্ষার সমস্যা ও অন্তরায় পাশাপাশি তার উত্তরণের উপায়। কাজেই
সমস্যাগুলোকে নির্দিষ্ট করতে পারলে সমাধানও মেলবে সহজে। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশও
সারা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠতে পারবে এক অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে।
বাংলাদেশের
উচ্চশিক্ষার অন্তরায় ও তার থেকে উত্তরণের সুপারিশ
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার
প্রধান অন্তরায়গুলো তুলে ধরা হলো একই সাথে কিছু যৌক্তিক সমাধানের সুপারিশও করা হলো। যদিও এর বাহিরে আরো অনেক
ধরনের সমস্যা বিদ্যমান, তবুও নিম্নে বর্ণিত সমস্যাগুলো সাধারণত আলোচিত হতে দেখা যায়। সমস্যাগুলোর
বিশদ ব্যাখ্যার পাশাপাশি সম্ভাব্য সমাধান আলোচিত হয়েছে।
১। ভাষাগত জটিলতাঃ উচ্চ-শিক্ষার
মাধ্যম কী হবে, কোন ভাষায় দেয়া হবে পাঠদান – এই বিষয়ে স্বাধীনতার পর পরই শুরু হয়
জল্পনা-কল্পনা। এই বিষয়ে আজো নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত দেখা যায়নি। অনেকে বলে থাকেন
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানোর জন্য ইংরেজি বইয়ের বিকল্প নেই, বিশেষ করে প্রকৌশল,
মেডিক্যাল, ও বিজ্ঞান বিষয়ে গুণগত ও মানসম্পন্ন বইয়ের জন্য ইংরেজির দ্বারস্থ হতে
হয়। সেজন্য এসব ক্ষেত্রে ইংরেজি বই থেকে পড়তে হয়। ইংরেজিতে অদক্ষ শিক্ষার্থীরা সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে
গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়। তদুপরি মাতৃভাষায় কোনো বিষয় যত সহজবোধ্য ক’রে উপস্থাপন
করা যায়, অন্য ভাষায় সেটা প্রায় অসম্ভব। কাজেই রাষ্ট্রের উচিত ছিল একটা শক্তিশালী
অনুবাদ সংস্থা গড়ে তোলা, যাদের কাজ হবে
জ্ঞানজগতের বিভিন্ন শাখার প্রধান প্রধান বইগুলো অনুবাদ করা। এতে আমাদের
মাতৃভাষা বাংলাও সমৃদ্ধ হতো, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের গভীরতাও বাড়তো। জাতীয়
শিক্ষানীতি ২০১০ এ বিষয়ে দুটি ভাষায়ই প্রাধান্যের কথা বলা আছে। বাংলা ভাষার একটি
সমৃদ্ধ পরিভাষাকোষ রচনা বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
২। গবেষণাঃ উচ্চশিক্ষার
কথা বললেই আসে গবেষণার কথা, জ্ঞান-সৃষ্টির কথা। কিন্তু আমাদের দেশে
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই ক্ষেত্রে ভয়ঙ্করভাবে পিছিয়ে আছে। জ্ঞান সৃষ্টির জন্য দরকার
গবেষণা, দরকার নিবেদিতপ্রাণ গবেষক। আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সেটা করতে
শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বাজেট স্বল্পতার কথা বলা হচ্ছে বারবার। কিন্তু
নিবেদিতপ্রাণ গবেষকেরও অভাব আছে। এই দুটোর জন্য বাজেট বাড়ানো পাশাপাশি সত্যিকারের
গবেষকদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদেরকে দিতে হবে নিরবিচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার
উপযুক্ত পরিবেশ।
৩। ছাত্র-রাজনীতিঃ এককালে যে ছাত্র-রাজনীতির ছিল গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, সেটা
আজ শুধু ইতিহাস। শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র-রাজনীতি এখন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুটিকয়
ছাত্র-সংগঠন আজো নীতি ও আদর্শের চেতনা বুকে ধারন করলেও, বৃহৎ ছাত্র-সংগঠনগুলো
পরিণত হয়েছে দলবাজি, চাঁদাবাজি ও
পেশিশক্তির আখড়া হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করা,
ছাত্রদের অধিকার আদায়ে নিরন্তর সংগ্রাম করা ছাড়াও নেতৃত্ব তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভূমিকা অগ্রগণ্য; আমাদের অতীত ইতিহাসও তাই বলে। জাতীর দুর্দিনে আলোর মশাল হাতে পথ
দেখিয়েছিল যে ছাত্রসমাজ, জাতীর মেধাবী নের্তৃত্ব তৈরি হয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় হতে
সে-বিশ্ববিদ্যালয় আজ লয় প্রাপ্ত হ’তে চলেছে। এখনি সচেতন না হলে আমাদেরকে ভবিষ্যতে
আরো অনেক মূল্য দিতে হবে। ছাত্র-সমাজকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে আমাদের
উচ্চশিক্ষা তার সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না।
৪। সরকারি বরাদ্দের স্বল্পতাঃ শিক্ষার দায়িত্ব
রাষ্ট্রের নেয়া উচিত। সে-প্রেক্ষিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হওয়া উচিৎ সর্বোচ্চ, আর
উচ্চ-শিক্ষাখাত তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। উন্নত বিশ্বে শিক্ষাখাতকে
দেয়া হয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব। একবিংশ শতাব্দীতে এগিয়ে যাওয়া মানে শিক্ষা, জ্ঞান,
বিজ্ঞান, ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া আর তার জন্য চাই গুণগত শিক্ষা। নাম-মাত্র
বরাদ্দ আমাদের উচ্চ-শিক্ষাখাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই
খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর মানে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সামিল। এ-প্রসঙ্গে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানে মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে এখনও
বাজেটের অপ্রতুলতা আছে। গত বাজেটের ১৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হলেও তার এক শতাংশের মতো খরচ হবে
উচ্চশিক্ষায়, যা বেশ অপ্রতুলই। তবে এর
বাইরেও আরও কিছু উৎস থেকে অর্থ উচ্চশিক্ষায় জোগান দেওয়া হচ্ছে। যেমন
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে যে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পটি চলছে, সেখান থেকে মঞ্জুরি
কমিশনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থায়ন হচ্ছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ’।
৫। দলীয়করণঃ শিক্ষক
নিয়োগে দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল ও পঙ্গু
করে দিচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগসহ সব ধরনের নিয়োগে স্বচ্ছতা অপরিহার্য। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে
বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মে যেসব শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হয় সেখানে কর্মদক্ষতা ও
যোগ্যতা বিচার না করে দলীয়করণের করে উচ্চশিক্ষার গতিকে ব্যহত করা হয়। এটা বন্ধ
করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা আন্তরিক হলেই যথেষ্ট।
৬। মেধাবী শিক্ষকের
অভাবঃ বিবিধ কারণে মেধাবীরা আজ আর আগের মত শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। অন্য অনেক
পেশায় যে সুবিধা পাওয়া যায়, যে-ধরনের বেতন-কাঠামো শিক্ষকদের জন্য থাকা উচিৎ সেটা
পাচ্ছে না বলে অনেকে এই পেশায় আগ্রহ দেখাচ্ছে কম। তদুপরি উচ্চ-শিক্ষাঙ্গনে
রাজনৈতিক দূবৃর্ত্তায়নের কারণে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ও গবেষকরা যথার্থ কর্ম-পরিবেশ
প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন কর্মজীবনে। প্রকৃত
প্রতিযোগিতা না থাকলে এবং যথার্থ মেধার অবমূল্যায়ন হলে দেশের উচ্চশিক্ষা বেহাল
এ-অবস্থা থেকে কখনো বের হতে পারবে না।
৭। জবাবদিহিতার অভাবঃ বাংলাদেশের
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতার যথেষ্ট অভাব আছে। উদাহরণস্বরূপ
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটা যেমন ইতিবাচক দিক তেমনি
এই স্বায়ত্বশাসনের অপব্যবহারও ক্ষতিকর। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক
ছত্রছায়ায় অনেক ধরনের অপকর্মকে প্রশয় দেয়া হয় এবং বিরুদ্ধমতকে দমন করাসহ বিভিন্ন
ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রকৃত জবাবদিহিতা থাকলে এ-সব করার সুযোগ
কমে যেত।
৮। অনুন্নত ভৌত
অবকাঠামোঃ আমাদের দরিদ্রদেশের সম্পদ সীমিত। সীমিত সম্পদ দিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া
কঠিন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার সুযোগ খুবই সীমিত। বিশেষ করে বিজ্ঞানের
গবেষণার জন্য আমাদের যে ভৌত অবকাঠামো দরকার তার যথেষ্ট অভাব আছে। আমাদের ল্যাবগুলোতে
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগসুবিধা নেই বললেই চলে। সরকারকে এ-বিষয়ে নজর দেয়া
উচিৎ। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে এ-
৯। শিক্ষক রাজনীতিঃ মানুষ নিজেদের মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করে
যাবে কেননা মানুষ আদতেই একধরনের রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি তার শিরা-উপশিরায় প্রবহমান।
কাজেই রাজনীতিকে এখানে নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। আর উচ্চশিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যেহেতু আগামী নেতৃত্ব তৈরি হবে কাজেই এখানে রাজনৈতিক চর্চার
প্রয়োজনীয়তা আছে। আর শিক্ষক রাজনীতিও অদরকারী কিছু নয়। কিন্তু সমাজের সামগ্রিক
অবক্ষয়ের হাত থেকে শিক্ষরাও আজ মুক্ত নয়। শিক্ষক রাজনীতি আজ আর সংগ্রাম ও অধিকার
আদায়ের হাতিয়ার নয়, বরং ব্যক্তিগত আখের গোছানে থেকে শুরু করে দলীয় ধামাদরা হওয়ার
অপূর্ব সুযোগ। অনেক শিক্ষক আজ গবেষণা ও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের চেয়ে নির্দিষ্ট
রাজনৈতিক কর্মীর মত আচরণ করাকে সঙ্গত মনে করেন। দলীয় চশমা পড়ে আর যাই হোক সুবিচার
ও ন্যায় সঙ্গত আচরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ-বিষয়ে যত শীঘ্র শুভবুদ্ধির
উদয় হবে ততই মঙ্গল।
১০) সন্তোষজনক বেতন-কাঠামোর অনুপস্থিতিঃ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা অনেক ধরে
দাবী করে আসছেন তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো অনুমোদন করার জন্য। এটা তাদের
ন্যায়সঙ্গত দাবি। শিক্ষকেরা জাতি গড়ার কারিগর। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে শিক্ষকদের
বেতন কাঠামো স্বতন্ত্র। মেধাবীদের এই পেশায় টানতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু
বাস্তবতা হলো শিক্ষকতা পেশাকে আজো ঠিকমত মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। অন্যান্য যে-কোনো
পেশার তুলনায় শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা কম। উচ্চশিক্ষা-কে
গুরুত্বপূর্ণ ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে প্রাসঙ্গিক করতে হলে এই বিষয়ে সরকারকে ভাবতে
হবে।
১১। সুপরিকল্পনার অভাবঃ বলতে দ্বিধা নেই
আমাদের সব ক্ষেত্রে একধরনের অগোছালে ভাব বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রও এর থেকে
ব্যতিক্রম নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ-লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে
যাচ্ছে। তাদের সীমিত সম্পদ ও জনবল দিয়ে উচ্চশিক্ষায় একধরনের শৃঙ্খলা আনার চেষ্ঠা
চলছে। যদিও এখনো তা আশাব্যাঞ্জক হয়ে ওঠে নি তবুও আশার কথা তা অচিরেই হয়ে ওঠবে।
উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রনের জন্য এক্রিডিটেইশন বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মানহীন
সার্টিফিকেট বিক্রি কিংবা যখন তখন বিভিন্ন বিষয় খুলে ছাত্র ভর্তির দিন আশা করি শেষ
হয়ে আসবে।
১২। মেধার অবমূল্যায়ন ও মেধা-পাচারঃ মেধা-পাচার বা ব্রেন
ডেইন খুব পরিচিত শব্দ আজ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য
বিদেশ গিয়ে আর দেশে ফিরছে না মেধাবিরা। এটা যে-কোনো দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি। এরা
দেশের সম্পদ। এদেরকে যে-কোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনা উচিৎ। আর সে-জন্য ওদের মেধার মূল্যায়ন
যথাযথভাবে করা উচিৎ। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া সহ ওরা যাতে নির্বিঘ্নে গবেষণা ও
কাজ করতে পারে সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক
উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে দেশে ফিরে আসে না, তাদের ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট
নীতিমালা ও আইন থাকা উচিৎ। মেধাবীরা বিদেশে যাবে, সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা ও
অভিজ্ঞতা অর্জন করতে নিজ দেশের জন্য কাজে লাগাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে
যা হচ্ছে তা ভয়াবহ। প্রতিবছর হাজার শিক্ষার্থী, গবেষক বিদেশে চলে যাচ্ছে এবং এদের
মধ্য থেকে দেশ ফিরে আসছে গুটিকয়েক। এটা দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এই অপচয় ঠেকানো
না গেলে ভবিষ্যতে আমাদের দেশ তীব্র মেধা সঙ্কটে ভুগবে।
১৩। যুগোপযোগী শিক্ষা-নীতিমালার অভাবঃ সময়ের সাথে
তাল মিলিয়ে চলার জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা নীতিমালার প্রয়োজন আছে। আমাদের
যদিও সীমিত আকারের কিছু নীতিমালা আছে
কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগে তদারকি ও নজরদারির অভাব আছে। তদুপরি সময়ের সাথে সাথে যে
ধরনের পরিবর্তন বা পরিমার্জন দরকার তা সবসময় করা হয় না। উচ্চশিক্ষার নৈরাজ্য দূর
করতে হলে নীতিমালা তৈরি ও প্রয়োগ করার বিকল্প নেই।
১৪। সেশন-জটঃ সেশন-জট নামক বিভীষিকা
আজ আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই বিষয়ে সামগ্রিক কোনো
পদক্ষেপ আজো দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই আজ
সেশন-জটের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। অনার্স-মাস্টার্স সহ যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর
লাগার সেখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আট বছরেও শেষ করতে পারে না। আমার নিজের
অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে লেগেছিল সাড়ে সাত বছর লেগেছিল। আমার অনেক বন্ধুকে
দেখেছি আট বছরের বেশি লেগেছিল তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বের হতে। এই
যে তিনটা মূল্যবান বছর শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে কেড়ে নেয়া হলো, তার ক্ষতিপূরণ কে
দেবে? এ-বিষয়ে শিক্ষকদের কিছুই বলা যায় না। তারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি
করার চেষ্টা করে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতার চুড়ান্তে
পৌঁছে যায়। অথচ এর থেকে বের হওয়ার জন্য শুধুমাত্র একটু পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতাই
যঠেষ্ট। সময়মত পরীক্ষা নেয়া, একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা আর উত্তরপত্র
মূল্যায়ন করে সময়মত ফলাফল দেয়া শিক্ষকদের
কাজেরই অংশ । অথচ কিছু শিক্ষকের অবহেলা ও অলসতার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর
জীবন থেকে মূল্যবান কিছু বছর হারিয়ে যায়! এর আশু প্রতিকার না হলে আমাদের
উচ্চশিক্ষা যে তিমিরে আছে সে তিমিরেই থেকে যাবে।
১৫। শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয় ও পেশাদারিত্বের অভাবঃ পেশাদারিত্বের
অভাব বাংলাদেশের সর্বত্র। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তা থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষকদের
যে অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক মানদণ্ড ছিল, তা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। অনেক শিক্ষক নিজের
বিশ্ববিদালয়ে না পড়িয়ে অনৈতিকভাবে বিভিন্ন
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান টাকার জন্য। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কনসালটেন্সিতে
ব্যস্ত রাখেন নিজেদের। অথচ নিজের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে বসে থাকেন শিক্ষকের
আসায়। অনেক শিক্ষক গবেষণা করেন না, নিজে পড়াশুনা করেন না, নিত্য-নতুন জ্ঞান আহরণ
করেন না, শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন না। এটা শিক্ষকের পেশাদারিত্বের অভাব
এবং নৈতিক অবক্ষয়। এর জন্য বিভাগীয় শাস্তি ও প্রমোশন আটকে দেয়া ছাড়াও কঠোর
নীতিমালা থাকা উচিৎ।
১৬। নিম্নমানের গবেষণা ও একাডেমিক চৌর্যবৃত্তিঃ উচ্চশিক্ষার
উদ্দেশ্যই হলো নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি। আর তার জন্য প্রয়োজন গবেষণা। কিন্তু
দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমরা গবেষণায় অনেক পিছিয়ে আছি। বিজ্ঞানের গবেষণার কথা না
হয় বাদই দিলাম কিন্তু কলা, সামাজিক ও মানবিকী অনুষদের সাথে সম্পৃক্ত গবেষণায়ও খুব
বিশেষ কোনো নতুনত্ব দেখাতে পারছি না। তদুপরি অল্পস্বল্প যেসব গবেষণা হচ্ছে সেগুলোর
মৌলিকত্ব নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেন অনেকে। পত্র-পত্রিকায়
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা নিয়ে চৌর্যবৃত্তির খবর এসেছে। এ-বিষয়ে
কঠোর নজরদারি ও শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার।
১৭। মানহীন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ঃ প্রাইভেট
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছিল উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিষয়কে মাথায়
রেখে। গুটিকয়েক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানের ক্ষেত্রে কোনো রকম ছাড় না দিলেও অধিকাংশই
পরিনত হয়েছে সার্টিফিকেট সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভৌত-অবকাঠামো থেকে শুরু করে একাডেমিক ও গবেষণা ক্ষেত্রেও চরম
দীনতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব ক্যাম্পাস থাকার কথা
থাকলেও অধিকাংশরই নেই নিজস্ব ক্যাম্পাস। মঞ্জুরি কমিশনের তাগাদা স্বত্বেও অনেকে
ব্যর্থ হচ্ছে ন্যুনতম শর্ত পূরণ করতে। শিক্ষাকে সেবা না বানিয়ে ব্যবসার নামে
বাণিজ্য করার এই সুযোগ বেশি দিন দেয়া হবে
না বলে মঞ্জুরি কমিশন সতর্ক করে দিয়েছে। আশার কথা এর মধ্যে কয়েকটি প্রাইভেট
বিশ্ববিদ্যালয়কে কমিশন অবৈধ ঘোষণা করেছে।
১৭। অবহেলিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ঃ উচ্চশিক্ষার
ঘনীভূত সঙ্কটের জাজ্বল্যমানমান উদাহরণ হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিশাল সংখ্যক
উচ্চশিক্ষা প্রার্থীর শেষ আশ্রয়স্থল হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যের
বিষয় হলো অধিকাংশ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নেই ন্যূনতম ভৌত-অবকাঠামো, ল্যাব, এবং
পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক। আর সেশন জটের অভিশাপতো লেগেই আছে। গুণগত মানের উচ্চশিক্ষা
প্রদানে ব্যর্থ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আজ চরম
হতাশায় নিমজ্জিত। চাকুরি ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার। দেশের বিশাল এক তরুণ
ছাত্রগোষ্ঠী-কে এভাবে পিছিয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে
ঢেলে সাজাতে হবে অচিরেই। সবাইকে উচ্চশিক্ষা নেয়া থেকে বিরত রেখে বরং কারিগরি ও
বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যেতে প্রণোদনা দেয়া উচিৎ। তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীর চাপ কমবে। ভৌত-অবকাঠামো, লাইব্রেরি, ল্যাব প্রতিষ্ঠাসহ প্রচুর দক্ষ
শিক্ষক নিয়োগ না দিলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে তো আনবে না বরং
বিশাল এক অদক্ষ উচ্চশিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম তৈরি হবে যাদের কোনো কাজে লাগানো যাবে না। দেশের জন্য এরা বিশাল
বোঝা হিসেবে প্রতীয়মান হবে অচিরেই।
১৮। ভর্তিবাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁসঃ দেশের সব পাবলিক
মেডিক্যাল কলেজে একসাথে একই প্রশ্নে
ভর্তিপরীক্ষার আয়োজন করা হলেও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই বিষয়ে কেন অপারগ
তা বোঝা কঠিন। ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়লেও
শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ ভোগান্তি হয় তা অবর্ণনীয়। শিক্ষার্থী-বান্ধব পরিবেশ না
দেয়ার মানসিকতা খুবই নেতিবাচক মনোবৃত্তির পরিচায়ক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক যোগে একই
প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া এখন সময়ের দাবি। তবে সবক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস যেভাবে
মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে তা জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা না
গেলে আমরা জাতি হিসেবে পঙ্গু হয়ে পড়বো। আমাদের সামনে সীমাহীন বিপদ অপেক্ষা করছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের করণে
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মেধাবী শিক্ষার্থী পেতে হিমশিম খাচ্ছে। তদুপরি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভয়াবহ
হুমকি। সমন্বিত উদ্যোগে সামিল হয়ে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে এই ব্যাপারে কঠোর
হতে হবে এখনই।
উপসংহারঃ উল্লিখিত
সমস্যার বাহিরেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা বিদ্যমান। যুগের সাথে তাল
মিলিয়ে চলতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। এই ব্যর্থতা থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হচ্ছে
সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। সমস্যা নির্ধারণে আন্তরিক হলে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া
সহজ। একবিংশ শতাব্দী হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। আমাদের উচ্চ-শিক্ষাকে
যুগোপযোগী করতে হলে প্রচুর গবেষণা ও
শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শিক্ষা-খাতে বাজেট বাড়লে আদতে দেশেরই লাভ। কারণ এ-বাজেট
আসলে বিনিয়োগেরই নামান্তর। আর কে না জানে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগে লাভ বৈ ক্ষতি নেই -
সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে হোক আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই হোক। কাজেই আমাদের উচ্চ-শিক্ষা
খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হোক জীবনের
সবক্ষেত্রে আর এ-বিষয়ে সবার সদিচ্ছা থাকাটাও জরুরি।
তথ্যসূত্রঃ
১। জাতীয় শিক্ষানীতি
২০১০, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
২। ড আব্দুল মালেক ও
অন্যান্য, শিক্ষাবিজ্ঞান ও বাংলাদেশের শিক্ষা, র্যামন পাবলিশার্স, ২০১৭
৩। উচ্চ শিক্ষার সংকট
কাটাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ, দৈনিক সমকাল, ৩ মার্চ, ২০১৪
৪। উচ্চশিক্ষা,
গবেষণার অবকাঠামো ও কিছু প্রস্তাব, সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী, মতামত, বিডিনিউজ২৪ডটকম,
৩১ অক্টোবর ২০১৫
৫। উচ্চশিক্ষার
মানোয়ন্নে শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মকর্তাদের ভূমিকা, দৈনিক জনকণ্ঠ, ০৯ এপ্রিল ২০১৭
৬। উচ্চশিক্ষায় সঙ্কট
নেই, সমস্যা আছে, প্রফেসর আব্দুল মান্নান চৌধুরী, চেয়ারম্যান, ইউজিসি, পাক্ষিক
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস (http://campus.org.bd/online/single.php?ID=342#) ।
৭। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান ও সমাধান, শহিদুল ইসলাম, পরিচালক, বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট
অব লিবারেশন ওয়ার এ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ। ‘অমর
একুশের বক্তৃতামালা’য়
পঠিত,২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, বৃহস্পতিবার, উৎসঃ ফেসবুক।
৮। উচ্চশিক্ষায় নতুন
সমস্যা, মতামত, দৈনিক প্রথম আলো, ২০ জুন ২০১৪৯। জাতীয় শিক্ষানীতি এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ভাবনা, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, http://campus.org.bd/online/single.php?ID=1024
১০। ‘উচ্চশিক্ষা হবে বিশ্বমানের’, প্রফেসর আব্দুল মান্নান, চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিডিনিউজ২৪ডটকম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন