ভূমিকা
নেতা হওয়ার জন্য
প্রয়োজন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সবাই নেতা হতে পারে না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের
প্রত্যককে বিভিন্নভাবে নেতৃত্ব দেয়ার প্রয়োজন পরে। কিন্তু আমরা জানি সবাই এই কাজে
সফল হতে পারে না। মাত্র গুটিকয়েক পারে এই ধরনের কাজে এক অনন্য ও অসাধারণ
পারদর্শিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে। নেতৃত্বের এই বৈশিষ্ট্য কী জন্মগত না কি ক্রমাগত
প্রচেষ্টা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত হয় তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ আছে।
বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে নেতৃত্বের ধরন ও বৈশিষ্ট্যকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, দিয়েছেন
বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতবাদ। কিন্তু পৃথিবীর
অধিকাংশ বড় বড় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বের দিকে তাকালে বুঝতে পারি তারা হয়তোবা নেতা
হওয়ার জন্য জন্ম নিয়েছেন, অন্য কিছু হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হত কিনা তা এখন বলা
কঠিন। পৃথিবীতে যুগে যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন নেতার আবির্ভাব হয়েছিল, তারা
পৃথিবীকে দিয়েছেন অভাবিত শৌর্য, বীর্য, মেধা ও জ্ঞান। তারা পৃথিবীকে প্রগতির দিকে
আরেকটু অগ্রসর করে দিয়েছিলেন, মানুষের মুক্তির
ও সম্ভবনার বীজমন্ত্র কানের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
শিক্ষা মানুষের জীবনের
সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মুলত শিক্ষা মানুষের সম্ভাবনার অনন্ত দ্বার খুলে
দিয়েছিল। সেই আদিম যুগ থেকে আজকের এই আধুনিক যুগে পৌঁছতে মানুষকে পারি দিতে হয়েছিল
বহু বাধা-বিপত্তি। সেই যে মানুষ হাত মুষ্টি করে ধরতে শিখেছিল তারপর থেকে তাকে আর
পেছনে তাকাতে হয় নি, সে শিখে ফেলেছে কীভাবে হাতিয়ার বানাতে হয়, কীভাবে বিপদকে
তাচ্ছিল্য করে অসম্ভবের পানে ছুটে যেতে হয়, কীভাবে নিজেকে নিরন্তর ব্যপৃত রাখতে হয়
জগতের রহস্য উন্মোচন করতে, নিবিড় জ্ঞানের সাধনায়। আজকের পৃথিবীতে সেই টিকে থাকবে
যে প্রতিনিয়ত জ্ঞানসাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখবে।
শিক্ষাকে শুধু তথাকথিত
একাডেমিক জগতে আবৃত করে রাখলে হবে না,
তাকে মনে রাখতে হবে, কবি যেমন বলেছেন,
সারা বিশ্বজোড়া একটা পাঠশালা। আমরা সবাই সেই পাঠশালার ছাত্র।
শিক্ষা অর্জনের
পদ্ধতির বিবর্তন ঘটেছে, প্রতিনিয়ত তার পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটছে, কিন্তু জানার ও
শেখার যে তীব্র আদিম স্পৃহা তা আজো মানব জাতি সযত্নে তার বুকের ভেতর লালন করে
আসছে। যেদিন এই স্পৃহা থেমে যাবে সেদিন মানব জাতির প্রগতি থেমে যাবে, সেদিন মানব
জাতি স্থবির ও জড় হয়ে যাবে, ধ্বংস ও পতন হয়ে ওঠবে অবশ্যম্ভাবী।
এই স্পৃহা সবাই
সমানভাবে ধারন করে না। যে ধারন করে না সে কোনো ভাবেই নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
কারণ যার নিজের মধ্যে জানার ও শেখার তীব্র ও অদম্য বাসনা নেই সে কীভাবে অন্যকে
অনুপ্রাণিত করবে? তাকে অনুসরণ করবে, তার গুণকীর্তন করবে কোন সে মানুষ? সে কীভাবে
হবে আদর্শ শিক্ষক নেতা? ছদ্ম নেতা হওয়া যায়, কিন্তু সেটা সাময়িক, ইতিহাস সাক্ষী
ভণ্ড ও ছদ্মরা শেষ পর্যন্ত আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
কাজেই একজন আদর্শ
শিক্ষক নেতা হবে সেই ব্যক্তি যার মধ্যে উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে প্রতীয়মান
হবে। তারপর আসবে তার অপরাপর গুণের কথা, অথবা অন্যন্য সমসাময়িক বৈশিষ্ট্য। যুগের
সাথে তাল মিলিয়ে যে ব্যক্তি পারবে গণমানুষকে পথ দেখাতে, মানুষের ভিতরের সুপ্ত
চেতনাকে জাগ্রত করে তাকে ন্যায়নিষ্ট, কর্মপরায়ণ ও জ্ঞানের প্রতি অনুগামী করতে –
সেই আদর্শ শিক্ষক নেতা হবার প্রাথমিক শর্ত পূরণ করেছে বলা যায়।
আত্মসচেতনতা নেতা হওয়ার
অন্যতম পূর্বশর্ত। know thyself – নিজেকে জানতে হবে।
জানার চেষ্টা করতে হবে অন্যদেরও। হতে হবে সচেতন সবকিছু সম্পর্কে। নেতার দুই চোখ
থাকলে হবে না, থাকতে হবে একাধিক চোখ। অন্তরের চোখ দিয়ে দেখতে হবে অনেক কিছু। শুধু
যুক্তি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করলে হবে না, সেখানে হৃদয়ের যোগসাজশ থাকার প্রয়োজনীয়তা
আছে। আত্মসচেতন নেতৃত্ব পারে এসবের ভেতর দিয়ে নিজেকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।
দৃষ্টান্তস্থাপনকারী নেতৃত্বের
প্রয়োজন আজকের আধুনিক শিক্ষা জগতে। শুধু কথার ফুলঝুরি দিয়ে আজকের পৃথিবীতে উন্নয়ন
ও পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেই নেতাকে মানবে ও গুণবে সবাই যে কথায় না বরং কাজ-কর্মে বড়
হবে। সে উপদেশ দিবে না, সেই নিজেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। শিক্ষায় এই ধরনের
নেতৃত্বের আজ বেশি প্রয়োজন। শিক্ষক তখনি নেতা হয়ে উঠবেন, যখন তিনি নিজে যা বলবেন
তা করার জন্য তিনি নিজেও প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রবাদ ‘উপদেশ অপেক্ষা
দৃষ্টান্ত ভালো’ বিশেষভাবে প্রযোজ্য। পৃথিবীর বড় নেতারা ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে
নিজেদের মহত্ত্ব প্রচার করেছেন।
সাহস ছাড়া কেউ কখনো
কিছু করতে পারে নি। সাহসে বলীয়ান অনেক কঠিন বাধা ও সমস্যাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা
যায়। এই সাহসের সাথে থাকতে হবে দৃঢ়চেতা
মনোভাব, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটাকে বাস্তবায়নের মতো তীব্র
মানসিক শক্তি। অনেক অনেক বড় বড় স্বপ্ন শুধু সাহসের অভাবে কখনো আলোর মুখ দেখে না।
সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভাবা উচিত, আর একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর সর্বশক্তি দিয়ে
তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। তবেই সাফল্য ধরা দেবে। সেই ব্যক্তিরা
হয়ে ওঠবে অন্যদের কাছে অনুকরণীয় নেতৃত্ব।
আবেগকে দুর্বলতা
না ভেবে বরং শক্তি ভাবা উচিত। তবে আবগের আতিশয্যে কেউ যেন লক্ষ্যচ্যুত না হয়। আবেগ
না থাকলে শক্তি আসে না। যুক্তি দেয় কৌশল, কিন্তু আবেগের ভেতর থাকে অবর্ণনীয় জোর ও
ক্ষমতা। এর সাহায্যে অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। শিক্ষক নেতার আবগে থাকা বাঞ্চনীয়,
অন্যদেরকে আদেশ নয় বরং নেতার নিজস্ব আবেগটি সঞ্চারিত করতে পারলে উদ্দেশ্য সাধনে
নিশ্চয়তা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
ন্যায়বিচারক নেতা পারে
সবার মধ্যে নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতাদের এই গুণটির
সবিশেষ প্রয়োজন আছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠান প্রধানের পক্ষপাতিত্ব ও
স্বজনপ্রীতির অভিযোগ থাকে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের এবং নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
অচিরেই এই ধরনের প্রতিষ্ঠান লয় প্রাপ্ত হবে। কাজেই এই ধরনের পরিস্থিতি যাতে তৈরি
না হয় প্রতিষ্ঠান প্রধানের সজাগ দৃষ্টি কাম্য। সবার বোধ-বুদ্ধি সমান নয়, একেকজনের
দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। এটা দোষ নয় বরং স্বাভাবিক। একজন আদর্শ নেতৃত্ব এই
ধরনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জটিলতা তৈরির আগেই সমাধান দেন। তবে নেতার
জাজমেন্ট-এ অযথার্থ হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
দূরদর্শিতা একজন শিক্ষক
নেতার খুবই প্রয়োজন। দূরদর্শী না হলে প্রতিষ্ঠান কখনো উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারবে
না। শুধু বর্তমানের প্রয়োজন নয়, বরং অদূর ভবিষ্যতে কীভাবে প্রত্যেকটা বিষয়ে সাড়া
দিতে এবং সে অনুসারে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে তার নির্দেশনা নেতার কাছ থেকে আসতে
হবে। তা না হলে নেতৃত্ব চরম ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হবে। শিক্ষা জগতে প্রতিনিয়ত
পরিবর্তন ও পরিমার্জন লক্ষণীয়। সিলেবাস, কারিকুলুম, টেকনোলজির সংযোজন ঘটিয়ে তার
প্রতিষ্ঠান যুগোপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
উত্তীর্ণ করা একজন দূরদর্শী নেতার কাজ।
প্ররোচক হওয়া
নেতৃত্বের আবশ্যকীয় গুণ। সে নিজে যা
বিশ্বাস করবে তার চাইতে বেশি চারিয়ে দেবে অন্যদের মধ্যে। নিজের প্রতিষ্ঠান কেন
অন্যদের চেয়ে সেরা সেটা অন্যদের কাছে খুব যুক্তিসঙতভাবে তুলে ধরতে হবে। কারণ এই
প্ররোচনাকে ইতিবাচক অর্থে আমরা মোটিভেশন বা অনুপ্রেরণা হিসেবে সাব্যস্থ করতে পারি।
শিক্ষার্থী, সহকর্মী এবং অভিভাবকসহ সবার মধ্যে নিজের প্রতিষ্ঠানকে আপন প্রতিষ্ঠান
হিসেবে ভাবার মত অনুপ্রেরণা ও রসদের যোগান দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন আদর্শ নেতা
খুব সহজেই নিজের বিশ্বাসকে অন্যদেরও বিশ্বাস হিসেবে চালিয়ে দেন। তার বাগ্মিতা,
আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ইত্যাদি এ-ক্ষেতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
শিখন ও শিক্ষণের
দুর্দান্ত ক্ষমতা একজন শিক্ষক নেতার কাছ থেকে কাম্য। তার জগতটাই এই দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত
হয়। কাজেই এই ক্ষেত্রে তার কোনো দুর্বলতা গ্রহণযোগ্য নয়।
সম্মান করতে হবে
অন্যদের আর সেটাই ফিরে আসবে নিজের সম্মান হয়ে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ধরনের অন্যায় অবিচারে স্বীকার যেন কেউ না হয় সে ব্যাপারে নেতার
সজাগ দৃষ্টি বাঞ্ছনীয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে কাজের পরিবেশ উন্নত হয় এবং সাফল্য
দ্রুত আসে।
গভীর অনুগত্য না থাকলে
প্রতিষ্ঠানকে ভালোবাসা সম্ভব নয়, আর প্রতিষ্ঠানকে ভালো না বাসলে সেই প্রতিষ্ঠানের
উন্নয়ন ও প্রত্যাশা পূরণ কঠিনই বটে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতাদের তাই অনুগত্য ও
বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নই একমাত্র লক্ষ্য, আর
প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে প্রকারান্তরে সবারই উন্নয়ন।
এছাড়াও সততা ( Honesty and Integrity), সহিষ্ণুতা, স্বকীয়
বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জল হওয়া, ভবিষ্যত আঁচ করতে পারা, সৃজনশীল ও
সৃষ্টিশীল হওয়া ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হওয়া একজন আদর্শ শিক্ষক নেতার জন্য অতীব জরুরী।
উপসংহারে এটা বলা যায় যে একজন আদর্শ শিক্ষক নেতার গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য কী কী হওয়া উচিত তার পরিসীমা নির্ণয় করা কঠিন। সময়ের সাথে সাথে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আদর্শ নেতৃত্বের সংজ্ঞার পরিমার্জন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে মৌলিক কিছু বিষয়ে আজো সবাই একমত। তাই আদর্শ শিক্ষক নেতৃত্বের অপরিহার্য বৈশিষ্ঠ্যগুলি সবার জানা উচিত।
Respect Sir. Long live
উত্তরমুছুন