অনেকদিন হয়ে গেল মাসাইমারা থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু গায়ে এখনো রয়ে গেছে সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের রোদ-মাখা ঘ্রাণ।
চোখে ভেসে উঠে নাবালক ইম্পালার লম্পঝম্প। পুরনো শার্টের বুকপকেট থেকে হয়তো হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলা সম্ভব লাইলাক ব্রেস্টেড পাখির ছোট্ট পালক। চোখ বুজলে ভেসে ওঠে নরম কচি ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দর্পিত সিংহের পাল
মাসাইমারার রাত্রিগুলো ছিল অদ্ভূত। আমার জীবনে এই ধরনের রাত্রি কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
চোখে ভেসে উঠে নাবালক ইম্পালার লম্পঝম্প। পুরনো শার্টের বুকপকেট থেকে হয়তো হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলা সম্ভব লাইলাক ব্রেস্টেড পাখির ছোট্ট পালক। চোখ বুজলে ভেসে ওঠে নরম কচি ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দর্পিত সিংহের পাল
মাসাইমারার রাত্রিগুলো ছিল অদ্ভূত। আমার জীবনে এই ধরনের রাত্রি কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
তবে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করলে এই অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। আমাদের থাকার জায়গাটা একটা ছোট্ট কুড়েঘরের মত। যদিও আধুনিক কিছু সুযোগ-সুবিধা ছিল। ছিল ইলেক্ট্রেসিটি, গরম-পানি। বাহির থেকে দেখে সেটা বুঝার উপায় নেই। তবে ছোট্ট একটা সমস্যা ছিল। সেটা হলো সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের অভাব। সেটা যদিও শাপে বর হয়েছিল শেষে। বিশেষ করে গভীর রাত্রে। রাত এগারটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। আর এই সময়টাই আমাদের সামনে মাসাইমারর অপরূপ ও রহস্যময় রাত্রির অপূর্ব সৌন্দর্য উন্মোচিত হ’তে থাকে। বিশাল মরুভূমির মত স্থান। আদিগন্ত উন্মুক্ত শুধু মাঝে দুই চারটা ডালপালাসমেত গাছ। আর কিছুদূর পর পর ঝোপঝাড়। উঁচুনিচু পাহাড়ী ভূমি। তবে পাহাড় বলা খুব একটা সমীচিন হবে না। বরং অধিকাংশ স্থান টিলার মত। এই ধরনের উন্মুক্ত স্থান সাভানা নামে সমধিক পরিচিত। অনেক দূরে হয়তো বিচ্ছিন্ন কিছু পাহাড় মেঘের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর উপরে বিশাল অবারিত আকাশ। আকাশে বর্ণিল তারকারাশি। নবমী বা দশমীর চাঁদ।
আমার বাসস্থান-এর পিছনে অবারিত মাঠ ছাড়িয়ে গেছে অনেকদূর। এখান থেকে শুরু মাসাইমারা সাফারী পার্ক।
এটা শেষ হলে পর শুরু হবে তাঞ্জানিয়ার বর্ডার। আর সেখান থেকে সেরেংগেতি ন্যাশনাল পার্ক।
সত্যিই অনেক বিস্তৃত।
এটা শেষ হলে পর শুরু হবে তাঞ্জানিয়ার বর্ডার। আর সেখান থেকে সেরেংগেতি ন্যাশনাল পার্ক।
সত্যিই অনেক বিস্তৃত।
আমার কূড়েঘরের ঠিক সামনে মাসাইদের বসতি। ছোট্ট কূড়েঘরের ভেতর কাদা হয়ে ঘুমাচ্ছে মাসাইরা।
ওদের কাছে এখন গভীর রাত। আমাদের গ্রাম দেশের মতন। মাঝে মাঝে মাসাই পাড়া থেকে মিহি সুরে কুকুরের ডাক ভেসে আসে। কিন্তু সে ডাক ছাপিয়ে যায় বিভিন্ন অজানা প্রাণীর ডাক যেটা আসছে পেছন থেকে। প্রাণির ডাকবিদ্যায় আমার জ্ঞান কম। হায়েনা, শিয়াল বা এই ধরনের কোনো প্রাণীর ডাক বলে অনুমান করি। আমাদের আবাসগুলো পাহা্রা দেয়ার জন্য কিছু তাগড়া জোয়ান মাসাই পালা করে রাত জাগে। তারা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় টর্চ-লাইট হাতে। রাতে হয়তো যেকোনো সময় কোন বন্য প্রাণী ঢূকে পড়তে পারে লোকালয়ে। নিয়ে যেতে পারে ছাগল-গরু। আক্রমণ করতে পারে মাসাইদের কিংবা ঘুমের ঘোরে হয়তো কোনো পর্যটক চলে যেতে পারে হিংস্র প্রাণীর পেটে। রাতে প্রাণীরা আদৌ শিকারে বের হয় কি না আমার জানা নেই। তবে ওরা যেটা বললো তা হলো এ-ধরনের ঘটনার সংখ্যা খুবই কম।
আমি মাসাই যুবককে ঢেকে পাশে বসাই। রাতের নির্জনতা আর অন্ধকারে ওকে আমার আধিভৌতিক লাগে। ও পরিবারের কথা বলে যায়। বলে যায় তার শিশু-সন্তানের কথা। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। জিজ্ঞাসা করি তাদের পূর্ব-পূরুষের কথা। তাদের শিকারী জীবনের কথা বলতে বলতে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তার বুকের গভীর থেকে বোধহয় কোনো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বলে আমি অনুমান করি। সে তাদের ফেলে আসা দিনের কথা স্মরণ করে, গভীরে ডুব দেয় পুরনো সব স্মৃতির।
ওদের কাছে এখন গভীর রাত। আমাদের গ্রাম দেশের মতন। মাঝে মাঝে মাসাই পাড়া থেকে মিহি সুরে কুকুরের ডাক ভেসে আসে। কিন্তু সে ডাক ছাপিয়ে যায় বিভিন্ন অজানা প্রাণীর ডাক যেটা আসছে পেছন থেকে। প্রাণির ডাকবিদ্যায় আমার জ্ঞান কম। হায়েনা, শিয়াল বা এই ধরনের কোনো প্রাণীর ডাক বলে অনুমান করি। আমাদের আবাসগুলো পাহা্রা দেয়ার জন্য কিছু তাগড়া জোয়ান মাসাই পালা করে রাত জাগে। তারা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় টর্চ-লাইট হাতে। রাতে হয়তো যেকোনো সময় কোন বন্য প্রাণী ঢূকে পড়তে পারে লোকালয়ে। নিয়ে যেতে পারে ছাগল-গরু। আক্রমণ করতে পারে মাসাইদের কিংবা ঘুমের ঘোরে হয়তো কোনো পর্যটক চলে যেতে পারে হিংস্র প্রাণীর পেটে। রাতে প্রাণীরা আদৌ শিকারে বের হয় কি না আমার জানা নেই। তবে ওরা যেটা বললো তা হলো এ-ধরনের ঘটনার সংখ্যা খুবই কম।
আমি মাসাই যুবককে ঢেকে পাশে বসাই। রাতের নির্জনতা আর অন্ধকারে ওকে আমার আধিভৌতিক লাগে। ও পরিবারের কথা বলে যায়। বলে যায় তার শিশু-সন্তানের কথা। আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। জিজ্ঞাসা করি তাদের পূর্ব-পূরুষের কথা। তাদের শিকারী জীবনের কথা বলতে বলতে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তার বুকের গভীর থেকে বোধহয় কোনো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বলে আমি অনুমান করি। সে তাদের ফেলে আসা দিনের কথা স্মরণ করে, গভীরে ডুব দেয় পুরনো সব স্মৃতির।
একদা অনন্য অসাধারণ দিন ছিল তাদের। আজ মাসাইদের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো লোপ পেয়েছে। সবাই শহরে চলে যাচ্ছে।
পড়াশুনা করে চাকরি-বাকরি করে শহুরে ভদ্রলোক হয়ে যাচ্ছে সবাই। কেউ আর আসেনা মাসাই পাড়ায়। শুধু পিছিয়ে-পড়া মাসাইরা ধরে রেখেছে তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য। সেটাও বোধহয় বেশিদিন থাকবে না। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। পর্যটন-এলাকা হওয়ায় এখানকার আকশে-বাতাসে টাকা ওড়ে। পশু-পালন কেউ আর করতে চায় না, লাভ কম।
বরঙ ইংরেজি শিখে ট্যুর-গাইড হলে ভালো পয়সা-কড়ি মেলে, হোটেল বা রেস্টুরেন্ট দিতে পারলে তো কাঁচা পয়সা।
প্রচুর ট্যুরিস্ট-এর আনাগোনা এখানে সারা বছর ধরে। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করার জন্য কিছু মাসাই তাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়ে। গান-বাজনা দেখিয়ে পর্যটকদের থেকে পয়সা কামায়। এটা আর জীবনাচরণের সাথে খুব বেশি জড়িত নেয়, যেটা আগে ছিল। এখন এটা একধরনের ব্যবসা, রুটি-রুজির উপায়। যখন মাসাই মারার বিস্তীর্ণ প্রান্তর চাঁদের আলোয় মাখা-মাখি হয়ে যেত, উৎসব-পার্বণে যখন তারা গোল হয়ে নাচত জীবনরসে টইটুম্বুর হ’য়ে সে প্রাণবন্ত উদ্দামতা এখানে খুঁজতে যাওয়া বোকামি। এ-যে ফরমায়েশি নৃত্য, এখানে প্রাণের স্পন্দন চাইলেই কি আর আনা যায়! তাদের সোনালী অতীত আর আজকের বর্তমানের মধ্যে অনেক ফারাক।
পড়াশুনা করে চাকরি-বাকরি করে শহুরে ভদ্রলোক হয়ে যাচ্ছে সবাই। কেউ আর আসেনা মাসাই পাড়ায়। শুধু পিছিয়ে-পড়া মাসাইরা ধরে রেখেছে তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য। সেটাও বোধহয় বেশিদিন থাকবে না। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। পর্যটন-এলাকা হওয়ায় এখানকার আকশে-বাতাসে টাকা ওড়ে। পশু-পালন কেউ আর করতে চায় না, লাভ কম।
বরঙ ইংরেজি শিখে ট্যুর-গাইড হলে ভালো পয়সা-কড়ি মেলে, হোটেল বা রেস্টুরেন্ট দিতে পারলে তো কাঁচা পয়সা।
প্রচুর ট্যুরিস্ট-এর আনাগোনা এখানে সারা বছর ধরে। ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করার জন্য কিছু মাসাই তাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পড়ে। গান-বাজনা দেখিয়ে পর্যটকদের থেকে পয়সা কামায়। এটা আর জীবনাচরণের সাথে খুব বেশি জড়িত নেয়, যেটা আগে ছিল। এখন এটা একধরনের ব্যবসা, রুটি-রুজির উপায়। যখন মাসাই মারার বিস্তীর্ণ প্রান্তর চাঁদের আলোয় মাখা-মাখি হয়ে যেত, উৎসব-পার্বণে যখন তারা গোল হয়ে নাচত জীবনরসে টইটুম্বুর হ’য়ে সে প্রাণবন্ত উদ্দামতা এখানে খুঁজতে যাওয়া বোকামি। এ-যে ফরমায়েশি নৃত্য, এখানে প্রাণের স্পন্দন চাইলেই কি আর আনা যায়! তাদের সোনালী অতীত আর আজকের বর্তমানের মধ্যে অনেক ফারাক।
মাসাইমারা ন্যাশনাল রিজার্ভ-এর পরিচিতি
এটি একটি বিশাল গেইম রিজার্ভ যেটি কেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে নারক কাউন্টিতে অবস্থিত। তাঞ্জানিয়ার ন্যাশনাল
রিজার্ভ “সেরেংগেতি ন্যাশনাল পার্ক’’ মাসাইমারার সীমানা যেখানে শেষ ঠিক সেখান থেকে শুরু হয়েছে।রিফট ভ্যালি প্রভিঞ্চ-এর বিশাল ও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে হাজার প্রজাতির বন্য পশু-পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এ ন্যাশনাল রিজার্ভ। যার আয়তন প্রায় ১৫১০ বর্গ কিলোমিটার। শত শত বছর ধ’রে যে মাসাই উপজাতি এখানে বাস করছে তাদের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে মাসাইমারা। জুলাই থেকে আগস্ট-এর মধ্যে এখানে গেলে দেখা যায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, গ্রেট মাইগ্রেশন। এনিমেল প্লানেট বা জিওগ্রাফি চ্যানেল-এর বদৌলতে আমরা অনেকে দেখেছি এ-গ্রেট মাইগ্রেশন। মারা নদী অতিক্রম করে হাজার হাজার ওয়াইল্ড বিস্ট ধাবিত হচ্ছে মাসাইমারা ন্যশনাল রিজার্ভ-এর উদ্দেশ্যে। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে হাজারো প্রাণী। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি বছর প্রায় ২৫০০০০ ওয়াইল্ড বিস্ট ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আর বিভিন্নভাবে শিকারে পরিণত হয়ে তাঞ্জানিয়া থেকে মাসাইমারার এই পথ অতিক্রম করার সময় প্রাণ হারায়। এ এক অদ্ভূত খেয়াল প্রকৃতির। প্রতিবছর শীতে সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখি যেরূপ বাংলাদেশে আসে এও অনেকটা তেমনি। পার্থক্য শুধু পাখির বদলে পশু এবং সংখ্যায় অনেক অনেক বেশি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন