দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রতিবছর হিন্দুরা অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এই উৎসব পালন করেন। বাংলাদেশে এইবারের পূজার স্লোগান ছিল, 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।' তবে প্রতিবছরের মত এবারও বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙার মত ন্যাক্কারজনক কুকর্মের পূনরাবৃত্তি হয়। যদিও বিভিন্ন মন্দিরে উৎসবের কোনো ঘাটতি চোখে পড়ে নি। শেষ দিন পর্যন্ত ছিল পূজোয় অসংখ্য দর্শনার্থী। হিন্দু ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পুজোর উৎসবে সামিল হয়েছেন সোৎসাহে। কোনো বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াও সারাদেশে পুজো উদযাপিত হয়। যথাযথ নিরাপত্তা প্রদানে সাফল্যের জন্য প্রশাসন ও সরকার সকলের কাছে সবিশেষ প্রশংসা অর্জন করেন।
তবে দুর্গাপূজার প্রধান অনুষঙ্গ বিভিন্ন ধরনের প্রতিমা ও তাদের নির্মাণ শৈলী সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রতিমার শৈল্পিক-সৌন্দর্য, উৎসবের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে দু-চার লাইন লেখা যেতে পারে। আর সবশেষে বিভিন্ন মন্দিরে ঘোরার সময় আমার নিজে ক্যামেরায় তোলা কিছু ছবি পোস্ট করা হবে।
প্রতিবছরই পূজায় কিছু নতুনত্ব আসে। প্রতিমা নির্মাণে 'থিম' নির্ধারণ ক'রে সেভাবে পুজো-মণ্ডপ-কে সাজানো গত কয়েক বছর ধ'রে বেশ একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। মূর্তি নির্মাণে শিল্পীরা এখন অনেক স্বাধীনতা নিচ্ছেন, যেটা আগে খুব বেশি দেখা যেত না। প্রতিমার আঙিকে, গড়নে, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার-এর ব্যবহার সবকিছু-তে এসেছে অনেক বৈচিত্র্য। এবং প্রতিবছরই নতুন নতুন সব অনুষঙ্গ যোগ হচ্ছে। নতুন কোনো কিছুতে বিভিন্ন পুরাতনপন্থীরা সমালোচনা করলেও সেগুলো খুব বেশি ধোপে টিকছে না। ফলে শিল্পীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের নতুনত্ব-কে সবার কাছে তুলে ধরছেন, দেখাতে পারছেন তাদের স্বকীয়তা, অভিনব শিল্পী-মানস। এভাবে চলতে থাকলে যুগের ব্যবধানে পুজোর মধ্যে বৈপ্লবিক সব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে। অনেকে এতে সব 'গেল গেল' ব'লে রব তুললেও আমার মনে হয় অলঙ্গনীয় এই পরিবর্তন-ই জগতের নিয়ম। পৃথিবী এভাবেই এগোয়, এভাবেই এগোতেই থাকবে।
দুর্গা-প্রতিমা একটা শিল্প-কর্ম। এটা একটা অসাধারণ ভাস্কর্য-শিল্পকলা। কোনো কোনো শিল্পী দুর্গার রূপ-ভৈববকে গুরুত্ব দেন বেশি, কারো কাছে দেবী দুর্গা জগজ্জননী, মায়ের স্নেহময়ী চিরকালীন রূপে শোভিত করাতেই সার্থকতা, কোনো শিল্পী হয়তো অসুর সংহারী শক্তিরূপিনী চণ্ডীমায়ের বেশ-কেই মনে করেন যথার্থ। তাই মহামায়া-র রূপের শেষ নেই। ভক্তের চোখে, শিল্পীর চোখে তার বিচিত্র রূপ; আর সেই কারণের দুর্গা-প্রতিমা শুধু একটি মূর্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে নি, বরং হয়ে উঠেছি অসাধারণ শিল্প, ভাস্কর্য-শিল্প। আর এই শিল্প-সৌকর্য শুধু দুর্গা-প্রতিমাতে সীমাবদ্ধ নেই, লক্ষী-সরস্বতী, গনেশ-কার্তিক, অসুর ও দেবদেবীদের বাহন সবকিছুকেই আকর্ষণীয় করে নির্মাণের একটা প্রবণতা কাজ ক'রে প্রতিমা-শিল্পীদের। যেমন দুর্গার বাহন সিংহ, লক্ষীর পেঁচা, সরস্বতীর রাজহাঁস, কার্তিকের ময়ূর, গণেশের ইঁদুর, আর অসুরের বাহন মহিষ তৈরিতেও এসেছে বিভিন্ন অভিনবত্ব। বিভিন্ন ধরনের কলা-কৌশল, নতুনত্ব প্রতিবছর প্রতিমা দর্শন-কে অনেক নান্দনিক ও উপভোগ্য করে তুলছে। তাছাড়া বৈদ্যুতিক বাতি, নিয়ন আলোর চৌকষ ব্যবহার প্রতিমা-কে আরো দৃষ্টি-নন্দন ও মনোহর করছে। এবার চট্টগামের একটি পুজোয় মাটির পরিবর্তে ধাতুর তৈরি প্রতিমা নির্মাণ করা হয়েছে। পুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান-বাজনা আগের মতই আছে, ক্ষেত্রবিশেষে আরো উচ্চমার্গীয় হয়েছে, সার্বজনীন হয়েছে তবে হিন্দি গানের উৎকট ব্যবহার পুজোর সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্যকে ক্ষেত্রবিশেষে ম্লান করেছে। এছাড়া পূজার আরতি, ধূপ-ধুনো নিয়ে প্রতিমার সামনে নাচার যে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সেটা হারিয়ে যেতে বসেছে। অধিকাংশ মণ্ডপে এখন আর সেই রকম কোনো ব্যবস্থায় থাকে না। বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী, হরর শো, আলোছায়ার মাধ্যমে নাটকীয় বিভিন্ন মুহূর্তের উপস্থাপন, এনিমেশন শো ইত্যাদির মাধ্যমে পূজার চারিত্র্যই বদলে যাচ্ছে। পূজা যতটুকু না ভক্তির ব্যাপার ছিল একসময় এখন সেটা হয়ে ওঠেছে অনেক বেশি বিনোদন ও আনন্দ ও বাহ্যিক উৎসবের ব্যাপার। পুরো ব্যাপারটি একটা প্রদর্শনী, আর সেই প্রদর্শনী-তে কত চমৎকারিত্ব, বৈচিত্র্য আর চটকদারিত্ব আনা যায় সেই নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। তবে এরপরেও অনেকগুলো ঐতিহ্যবাহী মন্দির তাদের পূর্বের ঐতিহ্য-কে ধরে রেখে পূজা উদযাপন করে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন মন্দিরের প্রতিমা
ক) বনানী-গুলশান সার্বজনীন পূজামণ্ডপ, ঢাকা
খ) চেরাগীর মোড় পূজা মণ্ডপ, চট্টগ্রাম
ঘ) বংশাল একাদশ, পাথরঘাটা, চট্টগ্রাম
ঙ) ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, ঢাকা
চ) দেওয়ান পূজামণ্ডপ, চট্টগ্রাম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন