মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের শৈশবই অর্থাৎ শৈশবের স্মৃতি আমাদের বাঁচিয়ে
রাখে। এত গ্লানি, এত জরা, এত হাহাকার-কষ্ট চারিদিকে, কিন্তু একবার বাল্যে
কিংবা কৈশোরে ডুব দিলেই নিমেষে সব উধাও। স্মৃতিরা ডানা ঝাপটাতে থাকে, কান
পাতলে শুনি সেই সব শব্দ! চোখ বন্ধ করলেই দেখতে থাকি সবুজ কচি নিমপাতার ডাল,
নরোম নধর গায়ে বাটা-কাঁচা-হলুদের আলতো পরশ। চোখে ভাসে সেই সব দিন - খুব
সকালে যখন ভোরের আলোর আবছায়া ভাবটা কেটে যায়, কিন্তু চৈত্রের সূর্য তখনো
কড়া রোদের আঁচ নিয়ে হাজির হয় না, ঠিক সেই সময় বাড়ির সব ছোটরা উঠোনে পাটি
বিছিয়ে ফুলের ঝুড়ি আর সুঁই-সুতো নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ছোটরা উপলক্ষ্য
পেলেই হত, সেটা তাদের কাছে আসতেই না আসতেই হয়ে যেত উৎসব।
চৈত্র-সংক্রান্তিতে মালা গাঁথার জন্য আগের দিন সারা বাড়ি, পাড়া তন্ন তন্ন
করে যোগাড় করতাম বিভিন্ন ধরনের ফুল। সেটাও আমাদের কাছে ছিল ‘ফুল-তুলনি’
উৎসব! ভোর রাতে আধো অন্ধকারে বেশ দূরের একটি বাড়িতে যেতাম ফুল তুলতে, সৌখিন
বাড়িওয়ালার ছিল চমৎকার ফুল-বাগান, আমরা
কাকাতো-জ্যাঠাতো ভাইয়েরা বেড়িয়ে
পড়তাম ফুল-সংগ্রহের অর্থাৎ চুরির অভিযানে। সাথে সঙ্গী হতো বাড়ির পালিত
কুকুর ‘বাঘা’ও। আলো ফোটার আগেই ফিরে আসতাম আর আধো অন্ধকারে ফুলের ঝুড়ির
দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়তাম, ঝুড়ি উপচিয়ে সুগন্ধ ছড়াতো রঙিন সব
ফুলেরা। রঙ্গন, জবা, টগর, বেলি, অপরাজিতা, আর মাধবী লতা! সেখানে কখনো কখনো
স্থান করে নিত বুনো ভাটফুলও। আড়চোখে দেখে নিতাম অন্যদের সংগ্রহের পরিমাণ।
পরের দিন সকালে বিচিত্র সেই ফুলেরা আমাদের হাতের ছোঁয়ায় শিল্প-কর্ম হয়ে
যেত, আমরা গাঁথতাম বিচিত্র সব মালা, ঘরের দরজা-জানালায় যারা আসছে নতুন
বছরের নতুন মাসগুলোতে শোভাবর্ধন করে যাবে। আজকের শহুরে শিশুরা দিবাযত্নকেন্দ্রে, বিদ্যালয়ে সূক্ষ্ম পেশীর (fine motor) দক্ষতা আনয়নের জন্য কত
বিচিত্র খেলনা নিয়ে খেলে, আমরা সুঁই-সুতো আর বিনি সুতোর মালা গাঁথতে গাঁথতে
শিখে ফেলতাম আঙুলের কারুকার্যময় ব্যবহার। এবং এ-শিখন আমাদের চলতেই থাকতো
বিচিত্র সব জিনিস নিয়ে। মনে পড়ে, চারকোনা করে কাটা নারকেলের পাতার শলায়
থরে-বিথরে গেঁথে দিতাম সাদা ও নীলের মিশেলের দৃষ্টিনন্দন হরগোজা ফুল। এই
ফুলকে স্থানীয় ভাষায় বলতাম ‘কেকাঁডা’ ফুল। বুনো এই ফুলের গাছে থাকতে কাঁটা,
খুব সন্তর্পনে তুলতে হতো ফুলকে, তবুও হাতে লেগে যেত কাঁটার খোঁচা, সেই
খোঁচায় আঙুলের গায়ে দেখা দিত দু-একটা রক্তবিন্দু!

সকালের বিশাল
কর্মযজ্ঞ সেরে দুপুরে ধোঁয়া ওঠা ঈষদুষ্ণ পাঁচন খেতে খেতে আমরা পালন করতাম
চৈত্রের শেষ দিন। প্রচলিত সব সব্জির পাশে সেদিন স্থান পেত বিচিত্র সব বনাজী
ও ঔষধী শাক-সব্জি-লতা-পাতাও। হরেক রকমের ডাল আর মশলার মিশ্রণে এর স্বাদই
হয়ে যেত অন্যরকম। পুরো বাড়ির রান্না একসাথে এক পাতিলে হতো, উঠোনে গোল হয়ে
সবাই একসাথে আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ে ভোজনের কাজ সমাধা করতাম। সব মান-অভিমান,
কাজিয়া-ফ্যাসাদ সেই পাঁচনের সাথে গলাধঃকরণ করে নতুন বছরে নতুন ভাবে বসবাসের
শপথে বলীয়ান হত সবাই, অলক্ষ্যে-অগোচরে। ভালোবাসা আর সহযোগিতার সামাজিক
উপযোগিতা আমাদের দিত নতুনতর প্রেরণা। আজ আমাদের সেই বাড়ি প্রায় নিস্তব্দ,
বাড়ির উঠোন খাঁ খাঁ করে চৈত্রের দুপুরে, নববর্ষে মাদল-খোল-করতাল আর শঙ্খের
ঝংকার উঠে না, ছোটদের কলকাকলির সুর আর সুদূরে মৃদু গুঞ্জন হয়ে মিলিয়ে যায়
না বললেই চলে।

আজ করোনাক্রান্তিকালে বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুব।
কাকীমা, হন্ডিতবা, বড্ডা ভাই, বাবা এদের সবাইকে খুব মনে পড়ছে। সবাই একে একে
চলে যাচ্ছে, স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে সবাই! বাড়ির প্রতিটি ধুলিকণা জানত কার
পায়ের ছাপ কেমন, কে কেমন ছন্দে হেঁটে যেত এখানে-সেখানে; বাতাসেরা জানত কার
গলার আওয়াজ কেমন, কণ্ঠের স্বর কেমন করে ঢেউ খেলাতো তার গায়ে, পুকুরের জল
বুঝতো পারতো কে নেমেছে তার ভেতরে, হাতের আঙুল দিয়ে জলের গায়ে বিলি কেটে কে
কীভাবে দিত ডুব! তারাও হয়তো বেলা-অবেলায় খুঁজে মরে তাঁদের। আর আমি এখানে
এই অবেলায় বদ্ধ ঘরের ভেতরে একা একা ছটফট করি। বাবাকে ছাড়া এটা আমাদের প্রথম
বৈশাখ, আমার মোবাইলের পর্দায় বাবার নাম ভেসে ওঠে না কতদিন! ‘ও হুত, ও
যাদু’ বলে যেভাবে বাবা ডেকে ওঠত, সে সুর, সে তাল-লয় বাবার সাথে অনন্ত আকাশে
মিলিয়ে গেছে! বারান্দার গ্রীল ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা নিমগাছের কচি কচি ডাল-পালা আমার
বর্তমানকে ভুলিয়ে দেয় এখন। এখানে বাতাসে এখন ধুলো নেই, বিগত দিনের হালকা
বৃষ্টি নিমপাতার সবুজতাকে আরো স্নিগ্ধ ও কোমল করে তুলেছে, নিমফুলেরও যে আছে
একটা মোলায়েম মিষ্টি গন্ধ, সেটা আমাকে অবাক করে দিচ্ছে। এই একটি জিনিস -
নিমপাতার কচি ডাল - আমার ব্যাথাতুর, রোদন-ভরা মনকে নববর্ষের এই
ক্রান্তিকালে কিছু্টা ভালো লাগায় ভরিয়ে দিয়েছে। নববর্ষ সবার জীবনকে
সুখে-শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দিক। করোনার করাল থাবা থেকে সবাই মুক্ত থাকুক!

১লা বৈশাখ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ;
এপ্রিল ১৪, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ,
বনশ্রী, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন