ছবির
ভিনদেশী মানুষগুলোর জাতীয়তা ফরাসি। সত্তরের কাছাকাছি বয়স অনেকের। চাকুরি
থেকে অবসর নিয়ে অনেক দিন ধরে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে যাচ্ছেন। সবাই
ফ্রান্সের ভিন্ন ভিন্ন লোকালয়ের বাসিন্দা, কাছাকাছি এলাকার যদিও। আত্মীয়তার
বন্ধনের বা রক্তের বন্ধনে কেউ কারো সাথে জড়িত নয়। তবে হ্যাঁ, আত্মার বন্ধন
আছে সবার সাথে সবার। ওদের প্রধানতম উদ্দেশ্য মানব সেবা, জীবনের এই বয়সে
এসেও একটাই প্রচেষ্টা মানুষ হয়ে মানুষের কল্যাণে নিজেদের ব্যাপৃত রাখা।
এই করোনা কালে ওদের নিয়ে লেখার একটা কারণ আছে। ওরা এসেছিল বাংলাদেশে মাস চারেক আগে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। ওদের প্রজন্মের লোকেরা সাধারণত ইংরেজি জানে না বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সেই সুবাদে আমি ওদের সাথে দোভাষী ও অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছিলাম, ঘুরে বেড়িয়েছিলাম দিন দশেক ঢাকা ও রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে।
ওঁরা সবজি-বাগান করে, কাপড় সেলাই বা বোনার কাজ করে; নিজেদের জন্য নয় বরং যাদের অভাব আছে তাদেরকে দান করার জন্য, ওগুলো দিয়ে তাদের সহযোগিতা করার জন্য। ওরা নিজেদের দেশে বৃদ্ধদের জন্য কাজ করে, তাদেরকে সঙ্গ দেয়; বিপদে, প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ায়, সহযোগিতা করে। ওঁরা ধনীদের বা স্বচ্ছলদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেটা দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ করে। অসহায় অভিবাসী থেকে শুরু বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের পাশে ছুটে যায়। আর্থিক, মানসিক ও প্রয়োজনে আইনি সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে এসেছিল একটি এনজিও-র কার্যক্রম দেখতে, কীভাবে এই প্রতিষ্ঠান এদেশের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে; কীভাবে দরিদ্রদের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করছে সেগুলো সরেজমিনে দেখা, এই এনজিও-র সেবা নিয়েছে বা নিচ্ছে সেই লোকগুলোর সাথে কথা বলা এবং কীভাবে যে পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে তা সরাসরি তাদের মুখ থেকে শোনা ইত্যাদি। রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চল, আদিবাসী গ্রাম, ঢাকার বস্তি ছাড়াও অভাবের ছোবলে যেখানে ক্ষতবিক্ষত মানুষ, সেরূপ কিছু স্থানেও গিয়েছিল তারা।
করোনার এই ভয়াল সময়ে যখন ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশ বেশ নাজুক অবস্থায়, তখন ওদের নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছিল। তবে ওঁরা সবাই এখনো ভালো আছে। ঘরে বসে কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের লোকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাস্ক, সুরক্ষা সামগ্রী বানানো ছাড়াও বৃদ্ধাশ্রমের কর্মীদের জন্য বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা পোশাক বানানোর কাজ করছে। অন্যান্য কাজগুলোও সীমিত পর্যায়ে চালিয়ে যাচ্ছে।
ওরা মোট আট জন এসেছিল, দু-জন সেই এনজিও-র ফ্রান্স শাখার কর্মকর্তা। বাকি ছয়জন স্বেচ্ছাসেবক। নিজদের খরচে ওরা এসেছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেশে দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে আরো বেগবান করাই তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ওদের সাথে কাজ করার সময় আমি নিজের কথা নিজের দেশের মানুষের কথা ভাবছিলাম। এই বয়সে ওরা রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছিল। সকালে শুরু করতাম সেটা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত। আমি ক্লান্ত হয়ে যেতাম, কিন্তু ক্লান্তি ওদের ধারে-কাছেও ঘেঁষত না। ওরা এতটুকু সময়ও নষ্ট করতে চাইত না, বরং নির্ধারিত সময়কে যত বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা যায় সেই ব্যাপারে সচেষ্ট থাকত সবসময়। খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা ছিল খুবই সাধারণ, আয়োজনে ন্যুনতম বিলাসিতাও ছিলনা কেননা সেটা ওরা চায় নি।
আমি অবাক হই, ওরা কেন এসেছিল, এই বয়সে এই রকম একটা ভ্রমণে। ওরা চাইলে আয়েশী ভ্রমণে আসতে পারতো, তারকা হোটেলে থাকার সামর্থ্যও ওদের ছিল। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসেও আদিষ্ট হয়ে আসে নি, ভালো কাজ করলে পরকালে স্বর্গে অবিশ্বাস্য রকমের সুখে দিনাতিপাত করার সুযোগে পাবে সেই বিশ্বাস থেকেও আসে নি। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ম-বিশ্বাসী ছিল যদিও, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান এবং ধর্মপালন নিয়ে বিশেষ কোনো বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে নি। ধর্ম-পরকাল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে না এই রকম দুইজনকেও পেয়েছি একই দলে, অথচ সবাই ওরা একসাথে কাজ করে যাচ্ছে। কেউ কোনো বিবাদে জড়াচ্ছে না। মানব কল্যাণে কাজ করাটাই তাদের সবার কাছে প্রধান ধর্ম হয়ে গেছে।
ইউরোপে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালোর দিকে এখন। ওখানে মৃত বেশিরভাগ মানুষ বেশ বয়স্ক। আশি, নব্বই, একশ এইরকম। আমাদের দেশে বয়সের এই স্তরে পৌঁছানোর আগেই বেশিরভাগের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। জানি, ওরা খুব দ্রুত এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবে। জীবন আবার স্বাভাবিক হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ওরা আবার একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াবে।
আমাদের কী হবে সেটাই ভাবছি। অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আগেই ভাবতাম শিক্ষা নাই বলে এই অবস্থা। এখন আর এভাবে ভাবি না। কুসংস্কার আমাদের তথাকথিত শিক্ষিতরাও কম লালন করেন না।
ধর্ম এই উপমহাদেশের মানুষকে এগুতে দিচ্ছে না, ভবিষ্যতেও দিবে না। ধর্ম সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক একটা ব্যাপার। একান্তভাবে নিজের করে স্ব স্ব ধর্ম পালনের মধ্যে অহিতকর কিছু তো নেই, বরং ভালো। আত্মার শান্তি, মনের শান্তি, পরকাল ইত্যাদি আমাদের মনের গভীরের যে বিশ্বাস আমরা দীর্ঘকাল ধরে লালন করে আসছি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্বিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরী হয়ে, তা থেকে আমাদের বের হওয়া কঠিন। কিন্ত ধর্ম আজ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক ধ্যানধারণা সবকিছুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, কিন্তু ধর্ম সৎ, মানবিক, নৈতিক, যুক্তিপরায়ণ, বিজ্ঞানমনস্ক ও সংবেদনশীল মানুষ নির্মাণে কতটুকু ভূমিকা রাখছে বলা কঠিন। পৃথিবীর দূর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে এর কিছুটা উত্তর মেলে। দূর্নীতিবাজরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কেননা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস ধার্মিকেরা সৃষ্টিকর্তা, পরকালের ভয়ে অন্যায় কাজ করতে ভয় পাবে, বা ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদেরকে সেসব থেকে বিরত রাখবে। যদিও দেখা যায়, পৃথিবীর ধর্মহীন বা ধর্ম-কর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না সেই সব দেশে বরং দুর্নীতি নাই বললেই চলে। চোর, ডাকাত, অপরাধীর অভাবে সেখানে জেলখানার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের অঞ্চলে ভালো মানুষের সংখ্যা কমছে দিনকে দিন। এখানে সবাই নিজেকে খুব সৎ দাবি করে, ধার্মিক দাবি করে। ধর্ম-বিশ্বাস, ঈশ্বরবিশ্বাস ক্রমবর্ধিষ্ণু এই অঞ্চলে। সমান তালে বাড়ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা আর দূর্নীতিও। এত বিশ্বাসী এখানে, তারপরেও অনিয়ম আর দূর্নীতির ছড়াছড়ি। এত ভেজালের এই দেশে এসব দেখলে এখন আর অবাক হই না। এদেশের প্রায় সব সরকারী কর্মচারীর পরিবারের সদস্যদের বলতে শোনা যায়, তাদের বাবা বা ভাই বা স্বামী কিংবা বোন বা স্ত্রী খবুই সৎ। কিন্তু সরকারী অফিসগুলো তাহলে কীভাবে দূর্নীতির আখড়া হয় সেই প্রশ্নের উত্তর নাই। অনেক ধর্মগুরুর যথেচ্ছ মিথ্যাচার, ভণ্ডামী, শঠতা আমরা প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হতে দেখেও এই সব বিষয়ে চুপ করে থাকি। সমাজের কিছু মানুষ যারা অজ্ঞ, সরল তাদের কথা বাদ দিলেও সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির ভূমিকা এক্ষেত্রে রহস্যজনক।
এই সব অনাচার, অজ্ঞতার প্রতিবাদ না করাটা প্রকারান্তরে এইগুলোকে উৎসাহ দেয়ার নামান্তর।
করোনার এই ক্রান্তিকাল কেটে যাবে একদিন। এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে অসংখ্য ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। আরো আছে স্বেচ্ছাসেবীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাও দিয়ে যাচ্ছে অক্লান্ত সেবা, শ্রম; দানশীলদের দান পৌঁছে দিচ্ছে জায়গায় জায়গায়। বিজ্ঞানীরা দিন-রাত গবেষণাগারে পড়ে আছে, কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে যুগে যুগে এরাই সভ্যতাকে রক্ষা করেছে, যেদিন এরা ব্যর্থ হবে সেদিন বিলুপ্ত হবে মানুষ এই পৃথিবী থেকে। এটা আমি বিশ্বাসের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে বলছি না, তথ্য-উপাত্তের আলোকেই বলছি। বলতে দ্বিধা নেই, এই পৃথিবী যতটুকু এগিয়েছে তা এঁদের কর্মযজ্ঞে, এঁদের কল্যাণেই। জ্ঞান আর গবেষণাই মানুষের বেঁচে থাকার হাতিয়ার মানব সভ্যতার উষাকাল থেকেই। এদের আবিষ্কারে, এদের অবদানে সারা পৃথিবীর মানুষ বেঁচে থাকে, এগিয়ে যায়। তাহলে প্রার্থনা, উপাসনালয়, ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা এদের ভূমিকা? সেটা শুধুই বিশ্বাস। বিশ্বাসে রোগমুক্তি, মানবমুক্তি কতটুকু সম্ভব আমি জানি না, সেটা দর্শন আর অধ্যাত্মবাদের প্রশ্ন। সেটা স্থান, কাল, সময়ের প্রেক্ষিতে বদলায়ও হয়তো! চিকিৎসাবিজ্ঞান বা অন্য কোনো বিজ্ঞানের সাথে এর আছে কি কোন সম্পর্ক? ভারতের একজন বিশ্বাসীকে যে বাঁচায়, আমাজনের বিশ্বাসীর জন্য সে কাজ করে কি? কিংবা বালি দ্বীপের সেই বিশ্বাসীর জন্য? আমি জানি না, কারণ সেই বিশ্বাসীরা যার ওপর বিশ্বাস আনে তারাও তো ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই এটা আসলে জটিল প্রশ্ন। সেইজন্যই ভালো হয়, যদি সব ধরনের বিশ্বাসকে পালন করা যায় একান্তই ব্যাক্তিগতভাবে। আমার বিশ্বাস নিয়ে আমি শান্তির নীড় রচনা করি সমস্যা নেই, কিন্তু চাপিয়ে যেন না দেই অন্যের উপর। আসুন মানুষ ভজি। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। কেননা, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই মানুষ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তা, গায়ের রঙে বিভাজিত মানুষ নয়। সেই অবিভাজিত মানুষ, যাদের সাথে আছে পৃথিবীর সর্বমানবের হাজার-লক্ষ বছরের সংযোগ। যেই প্রাচীনতম ধারা থেকে সারা পৃথিবীতে আজ ছড়িয়ে-চ্ছিটিয়ে আছে কোটি কোটি মানুষ। বিচ্ছিন্নতায় নয়, সমগ্রে বিশ্বাস আসুক আমাদের। তখন সহজ হবে মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। শুধু মানুষ নয়, দাঁড়াতে হবে সব প্রাণেরও পাশে। হিংসা ও হিংস্রতা পরিহার করতে হবে। সবারই প্রয়োজন আছে পৃথিবীতে। এবং কেউ নয় অনিবার্য বা শ্রেষ্ঠ এই পৃথিবীতে। ‘মানুষই জগতের শ্রেষ্ঠ জীব’, এসব বানানো কথা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
সোমবার,
২০ এপ্রিল, ২০২০ খ্রি
করোনাকাল,
ঢাকা
এই করোনা কালে ওদের নিয়ে লেখার একটা কারণ আছে। ওরা এসেছিল বাংলাদেশে মাস চারেক আগে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। ওদের প্রজন্মের লোকেরা সাধারণত ইংরেজি জানে না বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সেই সুবাদে আমি ওদের সাথে দোভাষী ও অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছিলাম, ঘুরে বেড়িয়েছিলাম দিন দশেক ঢাকা ও রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে।
ওঁরা সবজি-বাগান করে, কাপড় সেলাই বা বোনার কাজ করে; নিজেদের জন্য নয় বরং যাদের অভাব আছে তাদেরকে দান করার জন্য, ওগুলো দিয়ে তাদের সহযোগিতা করার জন্য। ওরা নিজেদের দেশে বৃদ্ধদের জন্য কাজ করে, তাদেরকে সঙ্গ দেয়; বিপদে, প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ায়, সহযোগিতা করে। ওঁরা ধনীদের বা স্বচ্ছলদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেটা দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ করে। অসহায় অভিবাসী থেকে শুরু বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের পাশে ছুটে যায়। আর্থিক, মানসিক ও প্রয়োজনে আইনি সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে এসেছিল একটি এনজিও-র কার্যক্রম দেখতে, কীভাবে এই প্রতিষ্ঠান এদেশের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে; কীভাবে দরিদ্রদের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করছে সেগুলো সরেজমিনে দেখা, এই এনজিও-র সেবা নিয়েছে বা নিচ্ছে সেই লোকগুলোর সাথে কথা বলা এবং কীভাবে যে পরিবর্তনগুলো সাধিত হয়েছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে তা সরাসরি তাদের মুখ থেকে শোনা ইত্যাদি। রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চল, আদিবাসী গ্রাম, ঢাকার বস্তি ছাড়াও অভাবের ছোবলে যেখানে ক্ষতবিক্ষত মানুষ, সেরূপ কিছু স্থানেও গিয়েছিল তারা।
করোনার এই ভয়াল সময়ে যখন ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশ বেশ নাজুক অবস্থায়, তখন ওদের নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছিল। তবে ওঁরা সবাই এখনো ভালো আছে। ঘরে বসে কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের লোকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাস্ক, সুরক্ষা সামগ্রী বানানো ছাড়াও বৃদ্ধাশ্রমের কর্মীদের জন্য বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা পোশাক বানানোর কাজ করছে। অন্যান্য কাজগুলোও সীমিত পর্যায়ে চালিয়ে যাচ্ছে।
ওরা মোট আট জন এসেছিল, দু-জন সেই এনজিও-র ফ্রান্স শাখার কর্মকর্তা। বাকি ছয়জন স্বেচ্ছাসেবক। নিজদের খরচে ওরা এসেছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দেশে দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে আরো বেগবান করাই তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ওদের সাথে কাজ করার সময় আমি নিজের কথা নিজের দেশের মানুষের কথা ভাবছিলাম। এই বয়সে ওরা রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরিয়ে বেড়িয়েছিল। সকালে শুরু করতাম সেটা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত। আমি ক্লান্ত হয়ে যেতাম, কিন্তু ক্লান্তি ওদের ধারে-কাছেও ঘেঁষত না। ওরা এতটুকু সময়ও নষ্ট করতে চাইত না, বরং নির্ধারিত সময়কে যত বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ করা যায় সেই ব্যাপারে সচেষ্ট থাকত সবসময়। খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা ছিল খুবই সাধারণ, আয়োজনে ন্যুনতম বিলাসিতাও ছিলনা কেননা সেটা ওরা চায় নি।
আমি অবাক হই, ওরা কেন এসেছিল, এই বয়সে এই রকম একটা ভ্রমণে। ওরা চাইলে আয়েশী ভ্রমণে আসতে পারতো, তারকা হোটেলে থাকার সামর্থ্যও ওদের ছিল। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসেও আদিষ্ট হয়ে আসে নি, ভালো কাজ করলে পরকালে স্বর্গে অবিশ্বাস্য রকমের সুখে দিনাতিপাত করার সুযোগে পাবে সেই বিশ্বাস থেকেও আসে নি। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্ম-বিশ্বাসী ছিল যদিও, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান এবং ধর্মপালন নিয়ে বিশেষ কোনো বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে নি। ধর্ম-পরকাল ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে না এই রকম দুইজনকেও পেয়েছি একই দলে, অথচ সবাই ওরা একসাথে কাজ করে যাচ্ছে। কেউ কোনো বিবাদে জড়াচ্ছে না। মানব কল্যাণে কাজ করাটাই তাদের সবার কাছে প্রধান ধর্ম হয়ে গেছে।
ইউরোপে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালোর দিকে এখন। ওখানে মৃত বেশিরভাগ মানুষ বেশ বয়স্ক। আশি, নব্বই, একশ এইরকম। আমাদের দেশে বয়সের এই স্তরে পৌঁছানোর আগেই বেশিরভাগের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। জানি, ওরা খুব দ্রুত এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবে। জীবন আবার স্বাভাবিক হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ওরা আবার একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াবে।
আমাদের কী হবে সেটাই ভাবছি। অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আগেই ভাবতাম শিক্ষা নাই বলে এই অবস্থা। এখন আর এভাবে ভাবি না। কুসংস্কার আমাদের তথাকথিত শিক্ষিতরাও কম লালন করেন না।
ধর্ম এই উপমহাদেশের মানুষকে এগুতে দিচ্ছে না, ভবিষ্যতেও দিবে না। ধর্ম সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক একটা ব্যাপার। একান্তভাবে নিজের করে স্ব স্ব ধর্ম পালনের মধ্যে অহিতকর কিছু তো নেই, বরং ভালো। আত্মার শান্তি, মনের শান্তি, পরকাল ইত্যাদি আমাদের মনের গভীরের যে বিশ্বাস আমরা দীর্ঘকাল ধরে লালন করে আসছি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্বিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরী হয়ে, তা থেকে আমাদের বের হওয়া কঠিন। কিন্ত ধর্ম আজ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং নৈতিক ধ্যানধারণা সবকিছুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, কিন্তু ধর্ম সৎ, মানবিক, নৈতিক, যুক্তিপরায়ণ, বিজ্ঞানমনস্ক ও সংবেদনশীল মানুষ নির্মাণে কতটুকু ভূমিকা রাখছে বলা কঠিন। পৃথিবীর দূর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে এর কিছুটা উত্তর মেলে। দূর্নীতিবাজরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কেননা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস ধার্মিকেরা সৃষ্টিকর্তা, পরকালের ভয়ে অন্যায় কাজ করতে ভয় পাবে, বা ধর্মীয় মূল্যবোধ তাদেরকে সেসব থেকে বিরত রাখবে। যদিও দেখা যায়, পৃথিবীর ধর্মহীন বা ধর্ম-কর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না সেই সব দেশে বরং দুর্নীতি নাই বললেই চলে। চোর, ডাকাত, অপরাধীর অভাবে সেখানে জেলখানার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের অঞ্চলে ভালো মানুষের সংখ্যা কমছে দিনকে দিন। এখানে সবাই নিজেকে খুব সৎ দাবি করে, ধার্মিক দাবি করে। ধর্ম-বিশ্বাস, ঈশ্বরবিশ্বাস ক্রমবর্ধিষ্ণু এই অঞ্চলে। সমান তালে বাড়ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা আর দূর্নীতিও। এত বিশ্বাসী এখানে, তারপরেও অনিয়ম আর দূর্নীতির ছড়াছড়ি। এত ভেজালের এই দেশে এসব দেখলে এখন আর অবাক হই না। এদেশের প্রায় সব সরকারী কর্মচারীর পরিবারের সদস্যদের বলতে শোনা যায়, তাদের বাবা বা ভাই বা স্বামী কিংবা বোন বা স্ত্রী খবুই সৎ। কিন্তু সরকারী অফিসগুলো তাহলে কীভাবে দূর্নীতির আখড়া হয় সেই প্রশ্নের উত্তর নাই। অনেক ধর্মগুরুর যথেচ্ছ মিথ্যাচার, ভণ্ডামী, শঠতা আমরা প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হতে দেখেও এই সব বিষয়ে চুপ করে থাকি। সমাজের কিছু মানুষ যারা অজ্ঞ, সরল তাদের কথা বাদ দিলেও সমাজের শিক্ষিত শ্রেণির ভূমিকা এক্ষেত্রে রহস্যজনক।
এই সব অনাচার, অজ্ঞতার প্রতিবাদ না করাটা প্রকারান্তরে এইগুলোকে উৎসাহ দেয়ার নামান্তর।
করোনার এই ক্রান্তিকাল কেটে যাবে একদিন। এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে অসংখ্য ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী। আরো আছে স্বেচ্ছাসেবীরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারাও দিয়ে যাচ্ছে অক্লান্ত সেবা, শ্রম; দানশীলদের দান পৌঁছে দিচ্ছে জায়গায় জায়গায়। বিজ্ঞানীরা দিন-রাত গবেষণাগারে পড়ে আছে, কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে যুগে যুগে এরাই সভ্যতাকে রক্ষা করেছে, যেদিন এরা ব্যর্থ হবে সেদিন বিলুপ্ত হবে মানুষ এই পৃথিবী থেকে। এটা আমি বিশ্বাসের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে বলছি না, তথ্য-উপাত্তের আলোকেই বলছি। বলতে দ্বিধা নেই, এই পৃথিবী যতটুকু এগিয়েছে তা এঁদের কর্মযজ্ঞে, এঁদের কল্যাণেই। জ্ঞান আর গবেষণাই মানুষের বেঁচে থাকার হাতিয়ার মানব সভ্যতার উষাকাল থেকেই। এদের আবিষ্কারে, এদের অবদানে সারা পৃথিবীর মানুষ বেঁচে থাকে, এগিয়ে যায়। তাহলে প্রার্থনা, উপাসনালয়, ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা এদের ভূমিকা? সেটা শুধুই বিশ্বাস। বিশ্বাসে রোগমুক্তি, মানবমুক্তি কতটুকু সম্ভব আমি জানি না, সেটা দর্শন আর অধ্যাত্মবাদের প্রশ্ন। সেটা স্থান, কাল, সময়ের প্রেক্ষিতে বদলায়ও হয়তো! চিকিৎসাবিজ্ঞান বা অন্য কোনো বিজ্ঞানের সাথে এর আছে কি কোন সম্পর্ক? ভারতের একজন বিশ্বাসীকে যে বাঁচায়, আমাজনের বিশ্বাসীর জন্য সে কাজ করে কি? কিংবা বালি দ্বীপের সেই বিশ্বাসীর জন্য? আমি জানি না, কারণ সেই বিশ্বাসীরা যার ওপর বিশ্বাস আনে তারাও তো ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই এটা আসলে জটিল প্রশ্ন। সেইজন্যই ভালো হয়, যদি সব ধরনের বিশ্বাসকে পালন করা যায় একান্তই ব্যাক্তিগতভাবে। আমার বিশ্বাস নিয়ে আমি শান্তির নীড় রচনা করি সমস্যা নেই, কিন্তু চাপিয়ে যেন না দেই অন্যের উপর। আসুন মানুষ ভজি। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। কেননা, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই মানুষ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তা, গায়ের রঙে বিভাজিত মানুষ নয়। সেই অবিভাজিত মানুষ, যাদের সাথে আছে পৃথিবীর সর্বমানবের হাজার-লক্ষ বছরের সংযোগ। যেই প্রাচীনতম ধারা থেকে সারা পৃথিবীতে আজ ছড়িয়ে-চ্ছিটিয়ে আছে কোটি কোটি মানুষ। বিচ্ছিন্নতায় নয়, সমগ্রে বিশ্বাস আসুক আমাদের। তখন সহজ হবে মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। শুধু মানুষ নয়, দাঁড়াতে হবে সব প্রাণেরও পাশে। হিংসা ও হিংস্রতা পরিহার করতে হবে। সবারই প্রয়োজন আছে পৃথিবীতে। এবং কেউ নয় অনিবার্য বা শ্রেষ্ঠ এই পৃথিবীতে। ‘মানুষই জগতের শ্রেষ্ঠ জীব’, এসব বানানো কথা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
সোমবার,
২০ এপ্রিল, ২০২০ খ্রি
করোনাকাল,
ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন